চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে দক্ষ জনশক্তি
তথ্যপ্রযুক্তির আলোড়িত জয়যাত্রার এই লগ্নে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আজ বিশ্বব্যাপী এক বহুল আলোচিত শব্দমালা। শিল্পবিপ্লবের এই চেতনা, চিন্তা উৎপাদন ও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। বদলে দিচ্ছে জীবনের গতিধারা এবং পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি। ২০৪১ সাল লক্ষ্য রেখে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সফল করার বিষয়টি পরস্পর সাযুজ্যপূর্ণ বলে মতপ্রকাশ করছেন প্রাজ্ঞজনেরা।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক কল্যাণের ব্রত নিয়ে একটার পর একটা শিল্পবিপ্লব এসেছে। ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল প্রথম শিল্পবিপ্লবের। ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের সূচনা। ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট এবং ২০১৬ সালে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় তৃতীয় ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। বিশ্বে পর্যায়ক্রমে একের পর এক চারটি শিল্পবিপ্লব এসেছে, দেশ এই বিপ্লবের ঢেউও লেগেছে, কিন্তু প্রতিটি শিল্পবিপ্লবে দেশে পরনির্ভরই রয়ে গেছে। তাহলে সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের দেশে এত মেধাবী সন্তান, এতগুলো সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা কী? তাদের ভূমিকাই বা কী?
শিল্পবিপ্লব সফল করার জন্য আমাদের সবার প্রথমে প্রয়োজন ছিল মানবসম্পদ পরিকল্পনার। পরাধীন দেশে যা হয়তো কল্পনা করা কঠিন ছিল কিন্তু স্বাধীন দেশ, যে দেশ এক নদী রক্ত দিয়ে কেনা সেখানেও ৫০ বছরে মানবসম্পদ পরিকল্পনা হবে, না! শুধু মানবসম্পদ পরিকল্পনাই নয় অনেক পরিকল্পনা কিংবা নীতির ক্ষেত্রেও আমরা পশ্চাদমুখী। স্বাধীনতার ৪০ বছর পার করার পর একটি শিক্ষানীতি যদিও বা জাতি পেল কিন্তু পরবর্তী এক যুগেও তা বাস্তবায়নের আলো দেখল না। এখনো দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা স্বপ্নের মধ্য দিয়ে চলছে। যে শিক্ষানীতি আমরা পেয়েছি তা যে স্বাধীন দেশ উপযোগী—এমন দাবি করতে চাই না। তারপরও যা আছে তা যাঁরা শিক্ষানীতি প্রণয়নকারী হিসেবে দাবি করেন, তাঁরাও বাস্তবায়ন করতে চান না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিসেকশন টেবিলের আলোর নিচে রেখে জনগণের কল্যাণের নামে একের পর এক যে ঘোষণাগুলো আসছে তাতে সংসদে পাস হওয়া শিক্ষানীতি দায়িত্বপ্রাপ্তরা কেউ আদৌ পড়েছেন তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। জানা থাকলে তখন তো মানার প্রশ্ন আসে। শিক্ষানীতিতে কী ধরনের সুপারিশ আসবে তার জন্য অপেক্ষা করার ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তাও দায়িত্বপ্রাপ্তরা অনুভব করেন না। এমনভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবচ্ছেদ করার ফলে শিক্ষা যেমন মানহীন হয়েছে আবার শিক্ষা অনুযায়ী কর্মেরও কোনো সুযোগ নেই। দরিদ্র জনগণের করের টাকা দিয়ে পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণকারীরা একবারের জন্যও দরিদ্র জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না।
মানবসম্পদ পরিকল্পনা না থাকার কারণে দেশের জন্য কোন বিষয়ের কত জনবল প্রয়োজন, তার হিসাব কেউ জানে না। বেহিসাবিভাবে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। বোধকরি সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিশ্বাস করে জনসংখ্যা কোনো সমস্যাই নয়, পুরাটাই জনশক্তি। হয়তোবা তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন দক্ষতা অর্জন ছাড়া জনসংখ্যা জনশক্তি হতে পারে না। সরকার কারিগরি শিক্ষার প্রসারে সরকারি পলিটেকনিকের পাশাপাশি বেশুমার বেসরকারি পলিটেকনিকে দেশ ভরিয়ে তুলেছে। সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে শিক্ষক স্বল্পতা, কাঁচামালের অভাব, যুগোপযোগী বই ও যন্ত্রপাতির সরবরাহ নেই। আর শিক্ষাক্রম নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই মঙ্গল। তারপরও সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তবু ব্রিটিশ আমলের কিছু যন্ত্রপাতি আছে, কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই একটা ফ্ল্যাটে সীমাবদ্ধ। দক্ষতা অর্জনের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির শতকরা দুই-এক ভাগ সংগ্রহও এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব কি না, তা বিবেচনার দাবি রাখে।