‘দেশের অনেক ব্যাংকের পরিস্থিতিই এখন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মতো’
দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
একেবারে মোটা দাগে বলতে গেলে ব্যাংক খাত এখন যে অবস্থানে আছে, তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। অল্প কিছু ব্যাংকে আগেও সমস্যা ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মৌলিক সমস্যা ছিল খেলাপি ঋণ। তবে দেশের অর্থনীতিতে এ ব্যাংকগুলোর অবদানও যথেষ্ট ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবদান ছিল ইতিবাচক। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) দেশের কৃষকদের জন্য কাজ করেছে। আশির দশকের শুরুর দিকে প্রথম প্রজন্মের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকও সংকটে পড়ে। পরবর্তী সময়ে ওই ব্যাংকগুলো নিজেদের সংস্কার করেছে। খারাপ সময় কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু ব্যাংক খাতের এতটা খারাপ অবস্থা আগে কখনো দেখিনি। এখন বেশির ভাগ ব্যাংকেই সুশাসনের ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠেছে।
২০০৫ সাল-পরবর্তী চার বছর আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলাম। সে সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১০-১১ হাজার কোটি টাকা। এখন খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। ব্যাংক খাতের মোট ঋণের এক-তৃতীয়াংশ থেকে তেমন কোনো আয় নেই। এসব ঋণ আদায় হবে সে সম্ভাবনাও খুব কম। গভর্নর থাকা অবস্থায় আমি ব্যাংকগুলোকে রীতিনীতি মেনে চলতে বাধ্য করেছি। সে সময় সিআরআর, এসএলআর ঘাটতি হওয়ার মতো ঘটনা শুনতে হয়নি। খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ নীতিতে কোনো ছাড় দেয়া হতো না। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল নীতিও ছিল বেশ শক্ত। নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো শিথিলতা দেখানো হতো না। কিন্তু এখন ব্যাংকিং রীতিনীতি মেনে চলার কোনো বালাই নেই। ব্যাংক পরিচালকদের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিচারে আইন প্রয়োগে হেরফের হচ্ছে। কোনো অর্থ পরিশোধ না করেও প্রভাবশালীরা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করিয়ে নিচ্ছেন। আইন ও ব্যাংকিং রীতিনীতির ব্যত্যয় আগে দেখিনি।
গভর্নর থাকা অবস্থায় ব্যাংক খাত পরিচালনায় রাজনৈতিক চাপ কেমন পেতেন?
এর আগে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পলিটিক্যালি এত মোটিভেটেড ছিল না। রাজনীতিবিদরা ধরেই নিয়েছিলেন ব্যাংক খাত পেশাদারত্ব বজায় রেখে চলবে। ব্যাংক পরিচালনায় রাজনীতিবিদদের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। সে সময় যারা সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক হতেন, তাদের অনেকের হয়তো পলিটিক্যাল লিংক ছিল, কিন্তু সেটা এক্সপ্লোর করতেন না।
আমার সময়ে রাজনৈতিক আদর্শের কারণে কোনো ব্যাংকে ঝামেলা হয়নি। সে সময়ে কোনো ব্যাংক সিআরআর রাখতে ব্যর্থ হলে তা কঠোর দৃষ্টিতে দেখা হতো। আমার মনে আছে, সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক মাঝেমধ্যে সিআরআর, এসএলআর রাখতে পারত না। আমরা সরাসরি বলতাম সিআরআর, এসএলআর না রাখলে জরিমানা দিতে হবে। জরিমানা পরিশোধে বাধ্য করা হতো। কোনো ব্যাংকের মূলধন কিংবা প্রভিশন ঘাটতি থাকলে এজিএমের অনুমোদন দিতাম না। মনে পড়ছে, একটি ব্যাংকের এমডি কান্নাকাটি করে মাফ চাইলে তাকে বলা হয়েছিল, এত দিনের মধ্যে ঠিক করো। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকটি শর্ত পূরণ করেছে। কঠোর হস্তে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন করা হতো। ব্যাংকিংয়ে সুশাসন ও জবাবদিহিতা ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ ছাড় ছিল না।
কিন্তু ২০০৯ সাল-পরবর্তী সময়ে আমরা ভিন্ন নীতি দেখেছি। সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে রাজনৈতিক লোক নিয়োগ দেয়া হলো। পর্ষদে বসে তারা রাজনৈতিক কথাবার্তাই বলতেন। এর ফলাফল হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। বেসিক ব্যাংকের পর্ষদে রাজনৈতিক লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমে সফল একটি ব্যাংককে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান-এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রেও আমরা রাজনীতিকরণ দেখেছি। ফলাফল প্রতিটি ব্যাংক দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিরাও এখন রাজনৈতিক রঙ ধারণ করছেন। এটির ফলও ভালো হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।