রাজনীতির প্রেক্ষাপট পাল্টে যেতে পারে
কালবেলা : আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনীতিতে অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। দেশের রাজনীতি কোন পথে?
জি এম কাদের : এটি স্বাভাবিক। বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারই চেষ্টা করেছে নির্বাচনব্যবস্থা নিজের আয়ত্তে নিয়ে নির্বাচন করতে। অর্থাৎ নির্বাচনের ফল নিজের পক্ষে নেওয়ার সব চেষ্টা করা হয়েছে। নির্বাচন-সংক্রান্ত সব কার্যক্রম দলীয়করণ, আইন পরিবর্তন এবং নিজস্ব লোক ঢুকিয়ে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে পুরো ব্যবস্থা সরকারের পক্ষে কাজ করে।
এমন প্রবণতা স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই শুরু হয়েছে। প্রায় প্রত্যেক নির্বাচনের সময় এটি করা হয়েছে। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে বিরোধীরা এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করে। অনেক সময়ই পরিবর্তন আনতে সফল হয়েছে। আবার কখনো কখনো সফল হয়নি। এবারও আন্দোলন চলছে এবং সেটি সফল হবে কি না, সেটি ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। তবে এটি বোঝা যাচ্ছে যে, নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত একটা আন্দোলন চলবেই। যারা পরিবর্তন চাচ্ছেন, তারা মনে করছেন সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা আয়ত্তের বাইরে নির্বাচনব্যবস্থাকে না নিয়ে নির্বাচন করার কোনো অর্থ নেই। এর মধ্যে কিছু সত্যতাও রয়েছে। বিরোধী দলের জায়গা থেকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ খুব কম। তেমনি সরকার চাইছে নির্বাচন ব্যবস্থাটা নিজের আয়ত্তে রেখে সহজে নির্বাচন জিতে আবার ক্ষমতায় যেতে। সরকার বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত এ জায়গা থেকে কোনোভাবেই সরতে চাইবে না। এ পরিস্থিতিতে দেশে আন্দোলন কতটুকু সফল হবে আমি জানি না। তবে এ পরিস্থিতিতে নতুন একটা বিষয় যুক্ত হয়েছে, তা হলো বিদেশি চাপ। বিদেশিরা চাচ্ছেন একটি সঠিক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এর অর্থ হলো, নির্বাচনব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে একটি নতুন নির্বাচনব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। এ বিদেশি চাপটি সরকারকে অনেকটা বেকায়দায় ফেলেছে।
কালবেলা : এর কি কোনো সমাধান আছে?
জি এম কাদের : অবশ্যই এর টেকসই সমাধান রয়েছে। একবার ক্ষমতায় গেলে কেউ ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। ক্ষমতা অপব্যবহার করার এবং ভোগ করার একটা মানসিকতা আমাদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতায় গিয়ে তারা যখন দুর্নীতি লুটপাটে যুক্ত হয়, তখন তারা জনগণের কাছে জবাবদিহিতার কথা ভুলে যায়। যখনই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে জবাবদিহিতার প্রশ্ন আসে, তখনই তারা সেটিকে এড়িয়ে যেতে চায়। এর জন্য তারা নির্বাচনব্যবস্থা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়, যাতে জনগণের রায় ছাড়াই আবারও নির্বাচনে জিতে আসা যায়। দলগুলো এ ধরনের একটা ভাবধারা নিয়ে কাজ করে। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের রাজনীতিবিদরা কখনো চিন্তা করেন না যে, জনগণই দেশের মালিক এবং তাদের কাছে আমাদের জবাবদিহিতা করা উচিত। সেটা হলে দেশ ভালো চলে, দেশের উন্নয়ন টেকসই হয়, উন্নয়ন গণমুখী হয়, উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষ পায়। একই সঙ্গে দুর্নীতি, সরকারি সম্পদ লুণ্ঠন এবং মানুষের ওপর অত্যাচার-অনাচার, বৈষম্য ইত্যাদি কমে যায়। যখন সরকারকে জবাবদিহি করতে হয়, তখন সরকারকে অনেক ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে কাজ করতে হয়। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে লাগাম ছাড়া কাজকর্ম করার প্রবণতা গেড়ে বসে। দুর্নীতি করা, ক্ষমতার অপব্যবহার করা, জনগণকে তোয়াক্কা না করা, এগুলোতে ঝুঁকে পড়ে তারা। ফলে নির্বাচনব্যবস্থা নিজের হাতে না নিয়ে বা নিজের নিয়ন্ত্রণে না নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার সাহস তারা করেন না। এটা আমাদের জন্য, আমাদের রাজনীতির জন্য এবং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। নির্বাচনব্যবস্থাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে একটা স্বাধীন সংস্থায় পরিণত করতে হবে। এটা কীভাবে করা যায় সেটার ফর্মুলা আমরাও দিতে পারি অথবা চাইলে বিশেষজ্ঞরাও দিতে পারেন। সবাই মিলে একটা ফর্মুলা গ্রহণ করলে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এমন একটা প্রক্রিয়া দরকার যার মধ্যে সরকার চাইলেই নির্বাচনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। অন্য কেউ চাইলেও এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এটা হবে জনগণের জন্য আলাদা একটি আদালত। এটা পৃথিবীর সব দেশই করে ফেলেছে, এমনকি আমাদের আশপাশের দেশগুলোও করে ফেলেছে। কিন্তু আমরা করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে ক্ষমতার লোভ এবং ক্ষমতা পেলেই কোনোভাবে তা ছাড়া যাবে না এবং যতটা পারা যায় সেটাকে অপব্যবহার করতে হবে—এমন প্রবণতা আমাদের একটা ভালো নির্বাচনব্যবস্থার দিকে যেতে দিচ্ছে না।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একমত হলে সমাধান খুবই সহজ। আমাদের দেশে এ জাগরণটা তখনই ঘটে, যখন আমরা বিরোধী দলে থাকি। তখন আমরা বুঝতে পারি যে এটি দরকার। আবার ক্ষমতা পেলে সেই দলই আবার এটি চায় না। ১৯৯০ সালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু হলো, তখন বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ সবার দাবিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলো। এরপর বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন দিতে চাইল। তখন আবারও জাতীয় পার্টি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ সবাই আন্দোলন করে। ফলে এরকম একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, স্বাধীনতার এতদিন পরও আমাদের মধ্যে সামান্যতম দেশপ্রেম তৈরি হলো না, জনগণের প্রতি এতটুকু দায়িত্ববোধ এলো না। দেশের প্রতি এতটুকু দায়িত্ববোধ এলো না যে, আমরা সবাই মিলে এমন একটা নির্বাচনব্যবস্থা তৈরি করব, যেখানে কারও কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। তাতে জনগণ তাদের অধিকারটা পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করতে পারবে। জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
কালবেলা : এই মুহূর্তে আলোচনার ইস্যুতে পরিণত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন একটা সরকার। সরকার চাইছে না, কিন্তু বিরোধী দলগুলো চাইছে। সমাধান কী হবে?
জি এম কাদের : বিএনপি একবার একই কথা বলেছিল যে, এটা সম্ভব নয়। তখন আমরা তা মানিনি। আওয়ামী লীগও মানেনি। এমনকি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, চিরস্থায়ীভাবে হলেও আমরা একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাই। কাজেই পরবর্তীকালে তিনি ক্ষমতায় এসে আবার এটাতে রাজি হচ্ছেন না। এখন বিএনপি এটা চাচ্ছে। আমরা শুধু নিজের সুযোগ-সুবিধা দেখতে চাই, যেখানে আমরা চক্ষুলজ্জাও করি না। এগুলোর পরিবর্তন হওয়া দরকার। অবশ্যই আমাদের দেশের রাজনীতির কালচারটা আমরা নষ্ট করেছি।
আমরা যে নেতৃত্ব দিয়েছি এটা কোনোক্রমেই কোনো আদর্শ নেতৃত্ব নয়। এটা একটা লোভ-লালসা ও ব্যবসাভিত্তিক রাজনীতি। রাজনীতি করব জনগণকে লুণ্ঠন করার জন্য, রাজনীতি করব একটা লাভজনক ব্যবসায়ী হিসেবে—এ ধরনের একটা প্রবণতা আমাদের রাজনীতিতে ঢুকে গেছে। এর থেকে আমরা বেরোতে পারছি না।
আমাদের বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য সমাজ যেদিকে কোনো সুযোগ-সুবিধা পান নীতির কথা চিন্তা না করে, দেশের কথা চিন্তা না করে তাতে সমর্থন দিয়ে দেন। এটি শুধু এ সরকারের আমলে হচ্ছে তা নয়, বরং এর বিপরীত সরকারের আমলেও হয়েছে। তখন এ সরকার এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এ খেলাটা চলছেই, এর শেষ কোথায় সেটা আমি বলতে পারব না, শুধু আল্লাহ বলতে পারবেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে নির্বাচনব্যবস্থা সরকারের কুক্ষিগত করা অথবা একেবারে নিয়ন্ত্রণ করা থেকে বাইরে বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। এর জন্য অনেক ধরনের মডেল আছে, সেগুলোর মধ্য থেকে যে কোনো একটি মডেল নেওয়া যায়। অন্যান্য দেশ যেভাবে নির্বাচন পরিচালনা করছে, আমরা সেভাবে নির্বাচন পরিচালনা করছি না। অন্যান্য দেশ আমাদের মতো রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবাইকে দলীয় নেতাকর্মী বানাচ্ছে না। দলীয় নেতাকর্মী হিসেবে তাদের ব্যবহার করছে না। দলীয় নেতাকর্মী ও গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে নির্বাচন কেন্দ্র দখল করছে না। এগুলো কোনো দেশে করছে না এবং করতে দেওয়া হচ্ছে না। দেশগুলোতে সব রাজনৈতিক দলই এখানে একমত হয়েছে।