এমন সাংস্কৃতিক নির্মাণের সমালোচনাই যৌক্তিক
ইদানীং আমাদের সমাজে হালকা বিনোদন জোগানো সাংস্কৃতিক উপাদানের সমালোচনা ‘এলিটিস্ট’ বা উন্নাসিক বলে অবহেলার প্রবণতা চোখে পড়ছে। সংস্কৃতির ভিন্নতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা না থাকলে এলিট বা উচ্চ সংস্কৃতিকে কেউ টাকাওয়ালাদের সংস্কৃতি মনে করতে পারেন। এমন সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত মানুষদের লোকসংস্কৃতি-বিদ্বেষী ভাবতে পারেন। আবার কেউ শুধু বাণিজ্যিক লাভের জন্য তারল্যনির্ভর নির্মাণকে পপুলার কালচার বা জনপ্রিয় সংস্কৃতির উপাদান মনে করতে পারেন। যদি শুধু মুনাফা অর্জনের জন্য হালকা বিনোদন আর জৌলুসকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা উপাদান পপুলার কালচার হয়, তাহলে বব ডিলান, জোয়ান বায়েজ, জন লেনন বা জর্জ হ্যারিসনের মতো সংগীতশিল্পীর চিন্তাঋদ্ধ কথা আর অনুপম সুরের গানগুলো কোন সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হবে? আবার এলিট সংস্কৃতি যদি শুধু বিত্তবানেরই হয়, তাহলে তো বলতে হয়– শুধু তারাই প্লেটো, মার্কস, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়রের রচনা পড়েন। এ কথা বুঝতে তো অসুবিধা হয় না যে, মননশীল রচনা পাঠ, শৈল্পিক চলচ্চিত্র দেখা এবং নান্দনিকভাবে আকর্ষণীয় সংগীত শোনার প্রতি আগ্রহ শুধু টাকা-পয়সা থাকলেই তৈরি হয় না। মনে জ্ঞানতৃষ্ণা আর সূক্ষ্মবোধ থাকলেই তৈরি হয় এমন আগ্রহ। তাই অনেক বিত্তহীন ব্যক্তির বাড়িতেও দেখা যায় চিন্তাসমৃদ্ধ অনেক বই। অন্যদিকে, জ্ঞানতৃষ্ণা আর নান্দনিক বোধ না থাকলে অগাধ সম্পদের অধিকারীর ঘরও থাকতে পারে বইশূন্য। চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের প্রতিও তাঁরা আকর্ষণ অনুভব করবেন না।
সম্প্রতি নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেছেন, আমরা একটি রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একজনের উত্থান হয়েছে। এই বক্তব্য অনেকে সমর্থন করেছেন, অনেকে করেননি। হিরো আলমও তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অনলাইনে হিরো আলম তাঁর তৈরি করা বিভিন্ন ভিডিও আপলোড করার মাধ্যমেই পরিচিতি পেয়েছেন। যেহেতু তিনি দর্শকের জন্য কনটেন্ট তৈরি করছেন, সেই কনটেন্টের রূপ সম্পর্কে যুক্তি দিয়ে প্রশংসা কিংবা সমালোচনা করাই যায়। তাই হিরো আলমের সমালোচনা করা হলে বুঝতে হবে, সেই সমালোচনা দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা তাঁর নির্মাণের সমালোচনা; তাঁর সামাজিক অবস্থানের সমালোচনা নয়। তিনি গ্রামীণ পরিবেশ থেকে এসেছেন বলে তাঁকে খাটো করার জন্য সমালোচনা করা হচ্ছে– এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
বাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক বাউল আর বয়াতিরাও তো গ্রামের মানুষ। তাঁদের তৈরি করা সাংস্কৃতিক উপাদানের জন্য সমালোচনার পরিবর্তে সবসময় তাঁরা সমাদরই পান। গ্রামের মানুষ– এই কারণে বাউলদের সমালোচনা করা হয় না। কাজেই হিরো আলম গ্রামের মানুষ বলেই তাঁর সমালোচনা করা হচ্ছে– এমন কথায় যুক্তি থাকে না। আমাদের লক্ষ্য করতে হবে, গ্রামের মানুষ হলেও বাউল-বয়াতিদের কাজের সঙ্গে হিরো আলমের নির্মাণগুলোর পার্থক্য কোথায়।
হিন্দি ও বাংলা বাণিজ্যিক ছবিতে যে ধরনের নাচ-গানের দৃশ্য অহরহ দেখা যায়; ইউটিউবে হিরো আলমের বিভিন্ন ভিডিওতেও আমরা দেখি ঠিক তেমন দৃশ্য। এমন দৃশ্যে নারী উপস্থাপিত হয় পুরুষ দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য। গণমাধ্যমে আকর্ষণীয়ভাবে দেখানো বিষয় মানুষের আচরণ বহুলাংশে প্রভাবিত করে; সমাজের প্রথাগত ধারণাও সংহত করে। কাজেই চিন্তা করতে হয়– যেসব দর্শকের বিবেচনাবোধ নেই; নারীকে পণ্য হিসেবে দেখানো এমন ভিডিও তাদের কেমন আচরণে উদ্বুদ্ধ করবে। নারীকে দুর্বল ভাবার যে প্রবণতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোতে আছে, এমন ভিডিও সে ধারণাই পাকাপোক্ত করে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিতর্ক
- মার্জিত রুচি
- দেশীয় সংস্কৃতি