সুখের বিশ্বদৌড়ে বাংলাদেশ অসুখী কেন
জাতিসংঘ প্রণীত ‘বিশ্ব সুখ প্রতিবেদন ২০২৩’-এ ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১৮তম স্থান দখল করেছে। এ তালিকায় নেপাল (৭৮), পাকিস্তান (১০৮) কিংবা শ্রীলঙ্কার (১১২) তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও ভারতের (১২৬) কিঞ্চিৎ ওপরে অবস্থান করছে বাংলাদেশ।
মাননীয় মন্ত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ ‘বেহেশত তত্ত্ব’-এর প্রবর্তক হলেও এই প্রতিবেদনের পর কাউকে খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে শোনা যায়নি। তার কারণ দুটি—এক. বিষয়টি জাতিসংঘের উদ্যোগে হয়েছে বলে একে এককথায় নাকচ করে দেওয়া যাচ্ছে না। সুখ নিয়ে বাঙালি অত ভাবে না। সুখ কমে গেলে ‘কপালে সবার নাকি সুখ সয় না’—এটা মেনে নিয়ে শান্তি পায়। ‘টক শো’তেও সুখের আলোচনা জমে না। ঘরে সুখ না থাকলে জাতির সুখ নিয়ে ভেবে লাভ কী।
বার্লিনভিত্তিক এক প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো না হওয়ার পর মন্ত্রিস্থানীয় একজন পরামর্শক বলে দিলেন, ‘হিটলারের দেশ থেকে গণতন্ত্র শিখতে হবে না।’ মার্কিনরা গণতন্ত্র নিয়ে কিছু বললে একজন মন্ত্রী বললেন, মানবাধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশ আমেরিকা-ইংল্যান্ডকে কবেই পেছনে ফেলে দিয়েছে।
এর দুই কারণ—এক. নিজের দুর্বলতা টের পেয়ে অন্যের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে ছোট করার চেষ্টা। দুই. আমরা বেশ ভালো আছি—জনতাকে এ রকম একটা ধারণা দেওয়ার কসরত। এই দুর্বিনীত মনোভাব বজায় রাখলে শেখা যায় না। শুধু মাথাপিছু আয় বাড়লেই সুখী হওয়া যায় না। তার প্রমাণ ইরাক ও লিবিয়া। শান্তি ও ন্যায্যতা থাকা চাই।
প্রধানমন্ত্রী মানুষের মুখে হাসি দেখতে চাইছেন। এ জন্য তাঁর সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পগুলো কাজে দিয়েছে। কিন্তু বিধবা ও গরিবের সুরক্ষার নামে সঞ্চয়পত্র ধনীকে আরও সম্পদশালী করেছে। এই বৈপরীত্যগুলো সরাতে হবে। জাতিসংঘের সুখ সূচক নিয়ে ‘চুপচাপ’ থাকলে এসডিএফ বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। জনতার সুখের বিষয় নিয়ে ভাবনা ও গবেষণা করানো সুশাসকের লক্ষণ।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশ জনতার সুখের উন্নয়নে সুখবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছে। এটা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয় নয়। ওদের মাথাপিছু আয় ২০২২ সালে ছিল প্রায় ৪৮ হাজার ডলার। আয়–উন্নতির পাশাপাশি সমাজ যেন সুখী থাকে, সেটাই আমিরাতের শাসকদের চেষ্টা। বিশ্বসূচকে ওদের ২৬তম অবস্থান জাপানের (৪৭) চেয়ে ভালো এবং সৌদি আরবের (৩০) ওপরে। ইরাক (৯৮) ও ইরান (১০১) থেকে বেশ ঊর্ধ্বে।
সরাসরি সুখবিষয়ক মন্ত্রী না থাকলেও সমাজকল্যাণমন্ত্রী আছেন দেশে দেশে। বাংলাদেশেও এ রকম মন্ত্রণালয় ও এসডিএফের সমন্বয়ে একটা গবেষণা সেল করে সুখের বিষয়গুলোর ওপর প্রকল্পভিত্তিক কিছু করা প্রয়োজন, যাতে বাংলাদেশের অবস্থান অন্তত নেপালের ৭৮তম অবস্থানকে টেক্কা দিতে পারে। পাকিস্তানের (১০৮তম স্থান) পেছনে পড়ে থাকা লজ্জার বিষয়, বিশেষত রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণে। বছরখানেক সময়ে ২৪ ধাপ পিছিয়ে না পড়লে এ লজ্জায় পড়তে হতো না। এই এক বছরেই এত পিছিয়ে পড়ার কী কারণ। একে শুধু ‘পশ্চিমা ষড়যন্ত্র’ বলে চালিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এ জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। শুধু আনুগত্যের প্রত্যাশায় অবসরপ্রাপ্ত আমলা বা রাজনৈতিক সমগোত্রীয় খুঁজলে চলবে না। মেধাভিত্তিক নিযুক্তি আবশ্যক। মেধাবী আমলাকে পদে বসালেও তাঁকে দিতে হবে উদ্ভাবনের স্বাধীনতা। শুধু উন্নতমানের কেরানি দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালালে বিশ্ব উদ্ভাবন সূচকে ১০২তম স্থান দখল করতে হয়।