বায়ুদূষণ রোধে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় জরুরি
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। নেপালের কাঠমান্ডু ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৭ সালে এমফিল ও ২০১১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পরিবেশ ও দূষণ বিষয়ে তাঁর তিন শতাধিক গবেষণা ও আর্টিকেল বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
বায়ুদূষণ কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে বায়ুদূষণের পরিমাপ করা হয়?
আহমদ কামরুজ্জামান: প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলোর অন্যতম ‘বায়ু’। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে বায়ু তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে। অথচ জীবনধারণের জন্য বায়ু অত্যাবশ্যক। মানুষ পানি-খাবার গ্রহণ না করেও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে। যেমনটা আমরা তুরস্কে ভূমিকম্পের পর দেখেছি। কিন্তু বায়ু ছাড়া মানুষ এক মুহূর্ত বেঁচে থাকতে পারে না। আর মানুষের বেঁচে থাকা নির্ভর করে বায়ুদূষণের মাত্রার ওপর। বায়ুদূষণ পরিমাপের একক হলো মাইক্রোগ্রাম বা ঘনমিটার। এটি বায়ুদূষণ পরিমাপে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত মানদণ্ড।
বায়ুদূষণের ফলে মানুষের গড় আয়ু কমছে ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে– বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন?
আহমদ কামরুজ্জামান: দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণের ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট’ প্রকাশিত ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’-এর তথ্যমতে, বায়ুদূষণের কারণে সারাদেশে মানুষের গড় আয়ু প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর এবং ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের গড় আয়ু প্রায় আট বছর কমছে। বায়ুদূষণের কারণে ক্ষণস্থায়ী সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে নাক-মুখ জ্বালাপোড়া, মাথা ঝিম ঝিম ও ব্যথা করা, বমি বমি ভাব। অন্যদিকে ফুসফুসে ক্যান্সার, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, যক্ষ্মা, কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, জন্মগত ত্রুটি, দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব, হার্ট অ্যাটাক, যকৃৎ সমস্যা, অন্তঃসত্ত্বাদের ওপর প্রভাব, চর্মরোগ, নিউমোনিয়া ইত্যাদি দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণও বায়ুদূষণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণের ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর সারাবিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
বায়ুদূষণের দিক থেকে বর্তমানে বাংলাদেশ ও ঢাকার অবস্থা কেমন?
আহমদ কামরুজ্জামান: প্রায় প্রতিদিনই বিশ্বে বায়ুমান সূচক (একিউআই) প্রতিবেদনে ঢাকা শীর্ষ ১০-এর মধ্যে থাকছে। জানুয়ারি মাসেও ঢাকা দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বায়ুদূষণের সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করেছে মাত্র ৫ মাইক্রোগ্রাম। অপরদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর এই মাত্রা ১৫ মাইক্রোগ্রাম নির্ধারণ করেছে। ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের প্রাপ্ত তথ্য থেকে বিগত ৭ বছরের (২০১৭-২৩) ঢাকার বায়ুমান সূচকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ‘বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)’। গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল থেকে পাওয়া যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে রাজধানীতে বায়ুদূষণ আগের ৬ বছরের তুলনায় ১৫ গুণ ছিল। বায়ুদূষণ পরিমাপের একক অনুযায়ী ২৮১ দশমিক ২৪ মাইক্রোগ্রাম, যা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী খুবই অস্বাস্থ্যকর। ক্যাপস-এর গবেষণায় আরও দেখা যায়, বায়ুদূষণের দিক থেকে বিগত ৬ বছরের তুলনায় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
বায়ুদূষণের তালিকায় বাংলাদেশের নাম বারবার শীর্ষে উঠে আসছে। এর পেছনে কোন কারণগুলো বেশি দায়ী বলে মনে করছেন?
আহমদ কামরুজ্জামান: বায়ুদূষণের বেশ কিছু উৎস ও কারণ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু প্রাকৃতিক, কিছু মানবসৃষ্ট। প্রাকৃতিক উৎস ও কারণের মধ্যে রয়েছে– ভৌগোলিক অবস্থান, আন্তঃসীমানা বায়ুদূষণ, বায়ুর চাপ, বায়ুপ্রবাহ, বায়ুর তাপমাত্রা ইত্যাদি। এগুলোর প্রভাব খুব বেশি নয়। তা ছাড়া এগুলো নিয়ন্ত্রণে আমাদের কিছু করারও নেই। কিন্তু বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে দায়ী মানবসৃষ্ট উৎস ও কারণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য– নির্মাণ-সংশ্লিষ্ট কাজ, নিম্নমানের কয়লা ও জ্বালানি ব্যবহার, ফিটনেসহীন যানবাহন, জনসংখ্যার ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্মাণ ও সংস্কার কাজে সমন্বয়হীনতা।