জাতিরাষ্ট্র পাকিস্তান : অর্থ ও নীতির দ্বন্দ্ব
সমভাষা, সমবর্ণ এবং সমসংস্কৃতির জনগোষ্ঠীদের ‘জাতি’ বা ইংরেজিতে ‘নেশন’ বলা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘বাঙালি’, ‘গারো’, ‘ইংরেজ’, ‘বর্মী’ ইত্যাদি একেকটা আলাদা জাতি। একই জাতির ভেতরে একাধিক ধর্মের লোক থাকতে পারে, যেমন আছে বাঙালি জাতিতে।
ঊনবিংশ শতকের আগে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র একাধিক জাতি একই সাম্রাজ্যে এক শাসকের অধীনে বসবাস করত। ইতালি বা জার্মানিতে একাধিক জাতি-নগরের অস্তিত্ব ছিল। এইসব নগরের অধিবাসীরা ইতালীয় বা জার্মান ভাষায় কথা বলত না।
ইউরোপে ত্রিশ বছরের ধর্মযুদ্ধের পর ১৬৪৮ সালে জার্মানির ওয়েস্টফালিতে একাধিক সাম্রাজ্যের শাসকদের মধ্যে চুক্তি কিংবা ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর ইউরোপে ‘জাতিরাষ্ট্র’ বা ‘নেশন স্টেট’ নামে নতুন এক রাজনৈতিক সংগঠন অস্তিত্ববান হয়।
একাধিক জাতি আগে থেকেই একই ভূখণ্ডে বসবাস করে আসছিল। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারা হলো একই জাতিরাষ্ট্রের নাগরিক। ইংরেজ/ব্রিটিশ, আইরিশ এবং ওয়েলস তিনটি আলাদা জাতি (গোষ্ঠী) মিলে সৃষ্টি করা হলো ‘ব্রিটিশ’ রাষ্ট্রজাতি।
ওয়েলস এবং আইরিশরা প্রায় সবাই ইংরেজি বলতে পারে, যদিও ইংরেজরা প্রায় কেউই আইরিশ বা ওয়েলস বলতে পারে না। একইভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল জার্মান এবং ইতালীয় রাষ্ট্রজাতি। এক জাতি হতে স্বীকৃত হওয়ার পর ইতালি বা জার্মানিতে ধীরে ধীরে ভাষাগত ঐক্যেরও সূচনা হয়েছিল।
বাংলা শব্দ ‘জাতি’ কিংবা ইংরেজি ‘নেশন’ উভয়েই দ্ব্যর্থবোধক শব্দ। যুক্তিসম্মত আলোচনায় দ্ব্যর্থবোধকতা পরিহার্য। সুতরাং আমরা বলব ‘জাতিগোষ্ঠী’ এবং ‘রাষ্ট্রজাতি’। ‘আমার সোনার বাংলা’কে যখন ‘জাতীয় সঙ্গীত’ বলা হয় কিংবা বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় ‘জাতির পিতা’, তখন ‘জাতি’ শব্দকে ‘রাষ্ট্রজাতি’ অর্থেই ব্যবহার করা হয়।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠী যে নিজেদের বাঙালি বলতে চায় না সেটা এই কারণে যে, তারা ‘বাঙালি’ শব্দকে স্রেফ জাতিগোষ্ঠী অর্থে নেয়, রাষ্ট্রজাতি অর্থে নয়। তুরস্কের কুর্দিদের পাসপোর্টে জাতীয়তা লেখা থাকে ‘তুর্ক’, ওয়েলসদের পাসপোর্টে লেখা থাকে ‘ব্রিটিশ’। একইভাবে, জাতিগতভাবে যে ‘চাকমা’, রাষ্ট্রজাতিগতভাবে সে ‘বাঙালি’ হতে বাধা নেই।