মাংসাশী উদ্ভিদের সন্ধান মিলেছে দিনাজপুরে
সাধারণত উদ্ভিদ খেয়ে জীবনধারণ করে প্রায় সব প্রাণী। কিন্তু যদি বলা যায়, প্রাণী খেয়েও জীবনধারণ করে কিছু উদ্ভিদ তখন অবাক হওয়ার কথা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন উদ্ভিদ আছে। তবে এমন উদ্ভিদ বাংলাদেশেও আছে শুনলে অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, এমন উদ্ভিদের সন্ধান মিলেছে দিনাজপুরে। যার নাম সূর্যশিশির; এক প্রকার মাংসাশী উদ্ভিদ। সূর্যশিশিরের পাতাগুলো ছোট আর গোলাকার। উদ্ভিদটি আঠালো ফাঁদওয়ালা মাংসাশী উদ্ভিদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো ‘ডোসেরা রোটানডিফোলিয়া’।
দিনাজপুর সরকারি কলেজ ক্যাম্পাাসে প্রতি শীত মৌসুমে এই উদ্ভিদের দেখা মেলে। এবারও দেখা গেছে। তবে উদ্ভিদটি বংশবিস্তার কমিয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্ভিদটি বিলুপ্তির তালিকায় আছে।
দিনাজপুর সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা গেছে, কলেজের জীববিজ্ঞান ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে সূর্যশিশির ফুটে আছে। ওই বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী উদ্ভিদটি নিয়ে আলোচনা করছেন।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোট আকারের এই উদ্ভিদটি মাত্র ৩.৫ ইঞ্চি (৮ সে.মি.) চওড়া। এর পাতাগুলো ছোট এবং গোলাকার। গ্রীষ্মকালে গোলাকার পাতাগুলোর উঁচু কান্ডগুলোতে সাদা সাদা ফুল ফোটে। সূর্যশিশিরের পাতাগুলোকে উজ্জ্বল লাল রঙের দেখায়। মনে হয় ওগুলোর ওপর শিশির কণা চিকচিক করছে। লালচে শিশির বিন্দু দ্বারা আবৃত পাতাগুলো আসলে পোকামাকড় ধরার ফাঁদ। সূর্যশিশিরের পাতাগুলো বিভিন্ন উচ্চতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য বোঁটা দিয়ে ঢাকা থাকে। প্রত্যেকটি বোঁটার ওপর থাকে অতি ক্ষুদ্র একটি গ্রন্থি বা অঙ্গ। যা এক ধরনের স্বচ্ছ আঠালো তরল পদার্থ উৎপন্ন করে। এই তরল পদার্থটি বোঁটাগুলোর ওপর শিশির বিন্দুর মতো জমা হয়। তরল নিঃসরণকারী গ্রন্থিটি দেখতে লাল বলে এর ওপরের তরল পদার্থটিও লালচে বলে মনে হয়। সূর্যশিশির এক ধরনের সুগন্ধও বাতাসে ছড়ায়। মাছি ও অন্যান্য পোকামাকড় উজ্জ্বল লাল রঙ, শিশির বিন্দু আর সুগন্ধে আকৃষ্ট হয়ে উদ্ভিদের কাছে চলে আসে। কিন্তু পোকাগুলো গাছটির পাতার ওপর নামামাত্রই উঁচু বোঁটায় থাকা তরল পদার্থে আটকে যায়। এসব প্রাণী খেয়েই বেঁচে থাকে এই উদ্ভিদ।
কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, সূর্যশিশির উদ্ভিদটি বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। এই উদ্ভিদের জীবনকাল অল্প সময়ের। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় এর অঙ্কুরোদগম শুরু হয়ে টিকে থাকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত। উদ্ভিদটি ছোট হলেও তার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পোকামাকড় ও পতঙ্গ কাছে চলে আসে। তখন সেগুলোকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এজন্য মাংসাশী উদ্ভিদ বলা হয়। মরু অঞ্চলে এই উদ্ভিদ বেশি জন্মায়।
কলেজের শিক্ষার্থী আপন মাহমুদ বলেন, ‘মাছি ও অন্যান্য পোকামাকড় খেয়ে এই উদ্ভিদ বেঁচে থাকে। সব উদ্ভিদ, প্রাণী এবং বৃক্ষ পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এগুলোকে সংরক্ষণ করা জরুরি।’
শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, ‘সূর্যশিশির উদ্ভিদ আগে জেলার বিভিন্ন জায়গায় জন্মাতো। এখন তেমন চোখে পড়ে না। বিলুপ্তপ্রায়। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় এই উদ্ভিদ পোকামাকড় ও প্রতঙ্গ খায়।’
শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন বলেন, ‘সূর্যশিশিরের কথা বইয়ে পড়েছি। আজ আমাদের বিভাগের স্যার বাস্তবে দেখালেন। আমি মনে করি, এই অর্জন আমাদের বইয়ের পড়ার থেকে বেশি বাস্তবিক জ্ঞানের দিকে গুরুত্ব দেবে। আশা করি, আমরা সবাই এই জাতীয় উদ্ভিদের প্রতি যত্নশীল হবো।’
এ বিষয়ে দিনাজপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা জানি উদ্ভিদ বা গাছ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য পরিশোষণ করে বেঁচে থাকে। পৃথিবীতে প্রাণীখেকো উদ্ভিদের মধ্যে সূর্যশিশির একটি। এই উদ্ভিদের পাতায় নিঃসৃত কন্ট্রাক্টার হেয়ার জাতীয় আঠার সঙ্গে রাতে শিশির জমে যায়। সূর্যের আলোতে তা চিকচিক করে। এজন্যই মূলত এই উদ্ভিদের নাম হয়তো সূর্যশিশির। এই উদ্ভিদ থেকে এক ধরনের গন্ধে আকৃষ্ট হয় প্রতঙ্গ। ফলে প্রতঙ্গরা এই উদ্ভিদের কাছে এলেই আটকে যায়। আটকে যাওয়ার পর যত বেশি নড়াচড়া করে ততই পাতার কাঁটায় বাঁধা পড়ে। পরিশেষে প্রতঙ্গটি পরিশোষণ প্রক্রিয়ায় তাকে ভক্ষণ করে। এর জীবনকাল খুব কম। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চের মাঝামাঝি। মরু অঞ্চলে এই উদ্ভিদের জন্ম বেশি হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম ডোসেরা রোটানডিফোলিয়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি যখন এই কলেজের ছাত্র ছিলাম। তখন কলেজ ক্যাম্পাসের পশ্চিমে সূর্যশিশির জন্মে পুরো মাঠ লাল রঙে ছড়িয়ে যেতো। পরে বেগুন চাষ এবং মানুষজনের চলাচলের কারণে উদ্ভিদটি হুমকির মুখে পড়ে। এখন দুই-একটি করে জন্মায়। অনেকে এটিকে সংরক্ষণের কথা বলেছেন। আমি মনে করি, যেখানে মানুষের পদচারণা কম, সেখানে স্থান দিলে এই উদ্ভিদ বংশবিস্তার করতে পারবে।’
- ট্যাগ:
- জটিল
- মাংসাশী উদ্ভিদ