স্বাধীনতার পরপর দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল তাকে অনেকাংশেই একমুখী বলা যায়। শুধু কূটনীতিকদের সন্তানের পড়ালেখার জন্য ইংরেজি মাধ্যমের একটি স্কুল ছিল। বাকি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা মাধ্যমে পাঠদান করা হতো। এখনকার মতো বিভাজন সেই সময় ছিল না। কিন্তু ঢাকার পাশাপাশি মফস্বল শহরেও এখন ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা চলছে। দেশের অনাচেকানাচে ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে। উপজেলা পর্যায়েও অনেক পরিবার তাদের বাচ্চাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে বিব্রতবোধ করে। অথচ যারা আজ সমাজ ও দেশে প্রতিষ্ঠিত তাদের বেশিরভাগের শিক্ষা শুরু হয়েছিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
শিক্ষাব্যবস্থার বিভাজন শুধু বাংলা আর ইংরেজি মাধ্যমকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়নি। সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাসহ নানাভাবে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে। মাদ্রাসারও আবার রকমফের আছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। কী পড়ানো হচ্ছে তার খোঁজ নেই। স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসেও দেশের সব মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত পরিবেশন বাধ্যতামূলক করা যায়নি। সরকার ভূমিকা নিলে এসব অসংগতি দূর করা কঠিন নয়। সদিচ্ছা থাকলে এখনও একমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব।
ইদানীং পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্য পরিবেশনের অভিযোগ আসছে। এগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ শিক্ষার্থীদের সামনে কোনো ধরনের ভুল তথ্য উপস্থাপন করা যাবে না। মনের মাধুরী মিশিয়ে অবাস্তব ও কাল্পনিক বিষয়কে বাস্তব হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না। বিশেষ ধারণা চাপিয়ে দেওয়াও উচিত নয়। পাঠ্যবই হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক। এর মধ্যে থাকবে অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ; জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নিশ্চিত করার জন্য যা অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলে আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে টিকে থাকা যাবে না। বিদেশ থেকে শিক্ষার্থী এসে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ কিংবা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন। আমরা যদি আন্তর্জাতিক মানের কথা ভুলে যাই, সাম্প্রদায়িকতা পাঠ্যবইয়ে নিয়ে আসি, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।
এই ২০২৩ সালে এসেও বলতে হয়, আমরা আগের চেয়ে পিছিয়েছি। মোল্লাতন্ত্রের কাছে নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি জলাঞ্জলি দিচ্ছি। সন্তানদের পঙ্গু করে দিচ্ছি। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছি। ডারউইনের তত্ত্ব পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করায় দোষের কী হলো? বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে পরীক্ষিত তত্ত্ব ও তথ্য পাঠ্যবইয়ে সংযোজিত হতেই পারে। এটা মানা না মানা যে কারও ব্যক্তিগত বিষয়। যারা বলছেন, এই তত্ত্বটি স্কুল পর্যায়ে না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেওয়া যেত, তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করতে পারছি না। কারণ এই স্মার্টফোন ও ইউটিউবের যুগে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নেটে সার্চ দিয়ে সব দেখছে। তাহলে বৈজ্ঞানিক একটি তত্ত্ব লুকিয়ে রাখার মানে কী? আগেই বলেছি, মানা না মানা ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু জানার সুযোগ দিতে হবে।