এত অবহেলা কেন পাঠ্যপুস্তকে
বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে অন্যান্য উৎসবের মতো বই উৎসব হয় বছরের প্রথম দিনটিতে। জানুয়ারির আগেই প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে বই চলে যায়। প্রতিবছরই নতুন বই পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয় শিক্ষার্থীরা। নতুন বইয়ের নতুন ঘ্রাণ এক অন্যরকম অনুভূতি। তবে এ বছরও আনুষ্ঠানিকভাবে এই উৎসবের ঘোষণা থাকলেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীরা এখনো বই হাতে পায়নি। কারণ বই ছাপানোর ক্ষেত্রে এবার জটিলতা ছিল। বই ছাপার কাজ সম্পূর্ণ শেষ করতে পারেনি সরকার। তবে যারা বই পেয়েছে তারাও সব বই একসঙ্গে পাবে না। গণমাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ১৮ শতাংশ বই এখনো ছাপাই হয়নি।
এবার এই বই নিয়ে হচ্ছে বেশ কিছুটা তর্ক-বিতর্ক। প্রতিবছরই হয়। তবে খুব একটা গায়ে মাখেন না এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ। তবে এবারের বিষয়টি ভিন্ন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভুল তথ্যসহ আনেক ধরনের অসংগতির কথা বেশ কয়েকদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। বিশেষ করে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের নবম-দশম শ্রেণির বই আলোচনায় এসেছে সবচেয়ে বেশি। নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ের ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় তথ্য দেওয়া হয়েছে এভাবে যে, ‘পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আক্রমণ চালায় ও নৃশংসভাবে গণহত্যা ঘটায়।’ এখানে তথ্যগত দুটি ভুল আছে প্রকৃতপক্ষে রাজারবাগে ছিল পুলিশ লাইন্স আর পিলখানায় ছিল ইপিআর সদর দপ্তর (সূত্র : দৈনিক আমাদের সময় ১৪ জানুয়ারি)। একই বইয়ের ২০ পৃষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধে নারী সাবহেডিংয়ে লেখা আছে ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধর্ষিত হন প্রায় তিন লাখ মা-বোন। তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযাত্রী। তাদের ত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৬ সালে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।’ পাঠক লক্ষ্য করুন কোথাও তাঁদের লিখতে ওপরে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করা হয়েছে, আবার কোথাও করা হয়নি। একজন শিক্ষার্থী এখান থেকে কোনটা শিখবে? কিন্তু এ তথ্যটিও ভুল। সঠিক তথ্য হলো ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের পক্ষ থেকে এএইচএম কামারুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন। এবং তাঁরা মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদায় ছিলেন কারণ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সনদ যেটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইস্যু করা হয়েছে সেখানে বীর/বীরাঙ্গনা ছিল। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বীরাঙ্গনা’দের ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এখানে এটি না বললেই নয় যে, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত একমাত্র দেশ যে যুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীকে ‘বীর’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গত বছরের বইয়েও একই ভুল ছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সেটি শোধরানোর তাগাদা কেউ বোধ করেনি। তাই বছরের পর বছর একই ভুল জানছে শিক্ষার্থীরা। এর বাইরে আরও বইয়ে এ রকম ইতিহাসের ভুল রয়েছে। তেমনি আরেকটি বই হলো নবম এবং দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’। এই বইয়ে ২০০ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা আছে, ‘১২ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নিকট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।’ এ তথ্যটিও ভুল। সঠিক তথ্য হলো সেদিন বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়িয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। শুধু এখানেই শেষ নয়, একই বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যা’ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে।’ কিন্তু পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্যাতন, গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা শুরু হয় ২৫ মার্চ কালরাত থেকেই (দৈনিক আমাদের সময়, ১৪ জানুয়ারি)। ছাপা বইয়ে ইতিহাস এবং তথ্যে ভুল থেকে যাচ্ছে। বারবার পাঠ্যবইয়ে এই ধরনের ভুল নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকলেও খুব বেশি যত্নবান হচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। এমনকি গত বছরের ছাপা বইয়ে আঙুল দিয়ে দেখানো ভুল এ বছরের বইয়ে রয়ে গেছে বলে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে বই ছাপানোর মান নিয়েও। কয়েকটি বইয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের তথ্যের উপস্থাপন এবং ইতিহাসভিত্তিক তথ্য নিয়ে আগেও বেশ কয়েকবার তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু এখনো সেসব বিষয়ে সঠিক তথ্য দিয়ে পাঠ্যবই প্রকাশ করা কেন সম্ভব হচ্ছে না সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও খোলাসা হবে। অষ্টম শ্রেণির জন্য নির্ধারিত ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ে ১২২ পৃষ্ঠায় রাখাইনদের সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয় দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে, ‘রাখাইন পুরুষরা লুঙ্গি ও ফতুয়া পরে। পুরুষরা সাধারণত ফতুয়ার ওপর লুঙ্গি পরে। মন্দিরে প্রার্থনাকালীন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় ও লোকজ অনুষ্ঠানে তারা মাথায় পাগড়ি পরে। পাগড়ি তাদের ঐতিহ্যের প্রতীক। রাখাইন মেয়েরা লুঙ্গি পরে। লুঙ্গির ওপরে ব্লাউজ পরে।’ এই হলো উপস্থাপনা। আদৌ কি তারা তাদের পোশাককে বাঙালিদের মতো লুঙ্গি এবং ফতুয়া বলে? রাখাইন নারীদের পোশাককে আসলেই লুঙ্গি আর ব্লাউজ বলে? বাঙালিদের কাছে পাগড়িটি আসলে রাখাইনদের কাছে কী নামে পরিচিত? কেন তারা ধর্মীয় কাজে সেটি পরে? এ ধরনের উপস্থাপনা আসলে শিক্ষার্থীদের কাছে বাঙালি বাদে অন্য সংস্কৃতির মানুষদের সম্পর্কে কী ধারণা তৈরি করে?