শিশু-কিশোরদের যা শেখাবেন তা-ই শিখবে
পত্রপত্রিকায় মাঝেমধ্যে এমন সব চমকপ্রদ খবর বের হয়, যা পড়ে মনে হয় এখনো তাহলে এই বাংলাদেশেই অবিশ্বাস্য রকম সৎ লোক আছে, যারা সত্যিকার অর্থে নির্লোভ, নির্মোহ। এদের দেখে বা এদের কাহিনি শুনে বলতে ইচ্ছা করে : এরা আছে বলেই এখনো চন্দ্র-সূর্য ওঠে। নইলে কবে যে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হতো এই পাপপঙ্কিল দেশটার, শূলে চড়তে হতো দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজ, মুখোশধারী দুরাত্মাদের। নিজের জীবনের চাকা ঘোরাতে ব্যর্থ একজন সত্তরোর্ধ্ব রিকশাওয়ালাকে যখন দেখি তাঁর রিকশায় বেখেয়ালে ফেলে যাওয়া লাখ টাকার বান্ডিল মালিককে খুঁজে বের করে ফেরত দিচ্ছেন, বিনিময়ে কোনো পারিতোষিক গ্রহণে প্রকাশ করছেন সবিনয় অনাগ্রহ, তখন আমরা যারা সমাজের তথাকথিত স্মার্ট অধিপতি, তারা ঠোঁটের কোণে একটা উচ্চাঙ্গের হাসি দিয়ে হাজিরানে মজলিস স্তাবককুলকে বলি : ব্যাটা রিকশাওয়ালা একটা আস্ত বেকুব। এই বেকুবগুলোর কারণেই তো সমাজের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। আর আমি বলি, হায় রে, দেশের ঘরে ঘরে উচ্চ-নীচ সব পরিবারে যদি আরো বেশি বেশি এই সব তথাকথিত ‘বেকুব’ থাকত!
সততা নির্মোহতার পরাকাষ্ঠা শুধু যে বয়োবৃদ্ধরাই হবেন, এমন কোনো কথা নেই। হ্যাঁ, তাঁরা হয়তো পোড় খাওয়া জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে এসেছেন, বিবেকের অনেক অনুশাসন মেনে বিবেককে করেছেন সুতীক্ষ তরবারির মতো ক্ষুরধার। কিন্তু যে শিশুটি বা কিশোরটি জীবনের উষালগ্ন থেকেই মা-বাবা, পরিবার-পরিজন ও বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহোদয়দের কাছ থেকে ‘সদা সত্য কথা বলিবে’, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’, ‘পরদ্রব্য লোষ্ট্রবৎ’ ইত্যাদি আপ্তবাক্য বা তার সমার্থক কিছু শুনে শুনে এবং তাঁদেরকে এগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলতে দেখে অভ্যস্ত সে তো আর নিজের বয়ঃপ্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা করবে না। সে নিজেও তার মুরব্বিদের অনুকরণ-অনুসরণ করবে। প্রকৃতিগতভাবেই শিশু-কিশোররা অনুকরণপ্রিয়। বাবাকে যদি দেখে কুড়িয়ে পাওয়া একটি দা বা কাস্তে কিংবা একটি ১০০ টাকার নোট প্রকৃত মালিককে খুঁজে বের করে ফিরিয়ে দিচ্ছেন, ছেলেটি বা মেয়েটিও তখন স্কুলের মাঠে বা অন্য কোথাও পাওয়া বেওয়ারিশ কলমটি, টাকাটি, স্বর্ণের অলংকারটি নিজে গাপ্পু না করে যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এমনকি সে নিজে অভাবী এবং ওই কলম বা টাকার তার খুব প্রয়োজন হলেও সে লোভ করবে না।