গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
দুটি চেতনার কথা বিশেষভাবেই আসে। আসা দরকারও। একটি একুশের, অপরটি মুক্তিযুদ্ধের। এরা পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নয়। প্রথমটির সঙ্গে দ্বিতীয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বস্তুত একুশের চেতনাই প্রসারিত হয়ে রূপ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। '৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে আন্দোলনের সম্মুখযাত্রার সূচনা, সেটিতে ওই জাতীয়তাবাদের প্রত্যাখ্যান ছিল কেন্দ্রীয় ঘটনা। পুরোনো জাতীয়তাবাদের প্রত্যাখ্যান শুধু নয়; ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পথ ধরে সমষ্টিগত অগ্রযাত্রার শুরুও ওখান থেকেই। প্রবল বিরোধিতা ও নির্মম দমন-পীড়নের মুখে নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এগিয়েছে এবং সে আন্দোলনই পরিণতিতে কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে ভেঙে ফেলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, এটি অসাম্প্রদায়িক। ভাষা ধর্মীয় বিভাজন মানে না। সাম্প্রদায়িকতার অবরোধ ভেঙে ফেলে এগিয়ে যায়। ধর্মব্যবসায়ীরা বাংলা ভাষার ওপর নানা প্রকার সাম্প্রদায়িক উৎপাতের চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভাষা সেসব তৎপরতাকে মোটেই গ্রাহ্য করেনি; এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। ভাষা শুধু অসাম্প্রদায়িকই নয়; ধর্মনিরপেক্ষও বটে। ধর্মনিরপেক্ষতা অসাম্প্রদায়িকতাকেও অতিক্রম করে। কেননা, তার ভেতরে থাকে পরিপূর্ণ ইহজাগতিকতা।
ভাষা আত্মপ্রকাশ, সৃষ্টিশীলতা, সামাজিক যোগাযোগসহ অনেক কিছুরই মাধ্যম। ভাষার সাহায্যেই আমরা চিন্তা করি; অন্যের চিন্তাকে গ্রহণ করি; অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বেও লিপ্ত হই। ভাষা সমষ্টিগত স্মৃতির সৃষ্টিশীল সংরক্ষক। ভাষা ছাড়া তো মানুষ মূক ও বধির। অপরদিকে আবার ভাষা কোনো একটি শ্রেণির নিজস্ব সম্পত্তি নয়। ভাষার সৃষ্টি সমবেতভাবে, সমষ্টিগত উদ্যোগে। বিশেষ শ্রেণি, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোক; ভাষাকে যে আটকে রাখবে, সেটা সম্ভব নয়। অতীতে সম্ভব হয়নি; ভবিষ্যতেও হবে না।
এই যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও শ্রেণিবিভেদ না মানা; এর ভেতর রয়েছে গণতান্ত্রিকতা। গণতন্ত্র তো শুধু ভোটের ব্যাপার নয়; যদিও ভোট গণতন্ত্রকে কার্যকর করার একটি পদ্ধতি। ভোটের ভেতর দিয়ে মানুষ নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। ক্ষমতা কার হাতে থাকবে সেটি ঠিক করে দেওয়ার অবকাশ পায়। কিন্তু ভোটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ঘটবে- এমন নিশ্চয়তা যে সর্বদা থাকে; তা নয়।
বাংলাদেশে '৭০ সালের নির্বাচনে মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য যে রায় দিয়েছিল, তখনকার ক্ষমতাধররা সেটা মানেনি; উল্টো পাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়- এ আতঙ্কে রায়দানকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অতিমাত্রায় ভয়াবহ এক গণহত্যা ঘটায়। পরিণামে তারা অবশ্য ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ইতিহাসের আস্তাকুঁড় জিনিসটা অলীক কল্পনা নয়। যেটি আছে স্বৈরশাসকদের; সেটি চূড়ান্ত সমাধিভূমি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
- গণতন্ত্র