উদ্বাস্তুরা কোথায় যায়
বিশ্বমানচিত্রে উদ্বাস্তু যাত্রা শুরু সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। পশুদের যাত্রা শুরু হতো পানীয় জল আর খাদ্যের অভাবে। মানুষের শুরু শিকারভূমি আর কৃষিভূমির সন্ধানে। রক্তাক্ত লড়াইটা হতো গোত্রে গোত্রে। বাইবেলে প্রাচীন ইহুদিদের মিসর থেকে বিতাড়নের কাহিনী আছে। আছে দলনেতা নবী মুসার কথা এবং মহান ঈশ্বরের দ্রাক্ষা ক্ষেত্র আর যব শস্যভূমি কিংবা বনমধুর প্রাচুর্য দানের প্রতিজ্ঞার আখ্যান। আর এই আধুনিক যুগে উদ্বাস্তুযাত্রা শুরু ধর্মের নামে, রাজনৈতিক মতবাদের নামে নরহত্যা, নারী ধর্ষণের পথ ধরে। এই আধুনিকে আবার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় প্রাচীন আর মধ্যযুগ। রামায়ণ আর মহাভারতের মহাকাব্যিক যুদ্ধ এবং নরহত্যা যে ধর্মপ্রতিষ্ঠার নামে, ন্যায় স্থাপনের অসিলায়, তার সাথে আজকের অনেক মিল আছে। যুদ্ধ, হামলা, হত্যা, ধর্ষণ আর হিংস্রতার ফলে যে পলাতকদের উদ্বাস্তুযাত্রা শুরু হয় এই আধুনিক যুগে, তা পুরাতন যুগের দুর্ভিক্ষ আর জাতিদাঙ্গার পরিণামের চেয়েও ভয়াবহ।
অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ এশিয়া এবং আফ্রিকায় দীর্ঘস্থায়ী জাতিগত, ধর্মগত, বর্ণগত এবং মতাদর্শগত সংঘাত লাগিয়ে রেখেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে যা ঘটেছে এবং ঘটছে তার পেছনে রয়েছে দেশীয় এবং আন্তঃদেশীয় ষড়যন্ত্র। এই চক্রান্তের শেকড় অতি গভীর রাজনৈতিক মৃত্তিকাগর্ভে প্রোথিত। জনগণের গণতন্ত্রের দাবি, ক্ষুধামুক্তির দাবি, অন্ন-বস্ত্র-গৃহ-স্বাস্থ্য ইত্যাদির দাবির ভেতর দিয়ে বিক্ষোভ, ধূমায়িত হলেই কবির ভাষায় ‘সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা।’ জনগণের প্রতিবাদী দৃষ্টির ভেতর অ্যাসিড ছিটিয়ে অন্ধ বানানোর প্রশাসনিক প্রচেষ্টা চলে। আক্ষেপ এটাই, যে জাতি একাত্তরের অবিনাশী-অবিনশ্বর গৌরবের ইতিহাস স্রষ্টার ভূমিকায় নেমে বিশ্বকে চমকে দেয়, সে জাতিই ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িকতায় প্রেতনৃত্যে মেতে ওঠে। বাংলাদেশে এই কুৎসিত-কদর্য অপরাজনীতির শুরু স্বাধীনতা লাভের পরপরই।
একটি নির্মম প্রশ্ন আজ বেআব্রু হয়ে পড়ে। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক গৌরবের ইতিহাস কি কেবল স্বাধীনতা যুদ্ধ আর ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? অন্য ইতিহাস নেই? এদেশে কি তেভাগা আন্দোলন হয়নি? হাজী দানেশের ইতিহাস কি মাটিচাপা পড়েছে? কমরেড সিরাজ সিকদারের জনযুদ্ধ কি হাওয়ায় উড়ে গেল? মণি সিংহের হাজং বিদ্রোহ কি শিশুতোষ গল্প? সিলেটে নানকার বিদ্রোহটা কী? পাকিস্তান যুগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে প্রগতিশীল নাগরিকদের সাহসী ভূমিকা কি তুচ্ছ বিষয়? ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার সময় যুব ও ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনোরা যে দাঙ্গা প্রতিরোধে নেমে নিজেরা রক্তাক্ত হলেন তা তো অলীক গপ্পো!
- ট্যাগ:
- মতামত
- উদ্বাস্তু
- বাস্তুচ্যুত