শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত পুঁজিবাদ
আমাদের কাঙ্ক্ষিত সাহিত্য-সমালোচনার ধারাটি কেন বিস্তৃত হলো না এবং সাহিত্য-সমালোচনাই বা কেন বিকশিত হলো না—দুটি বিষয় কিন্তু পরস্পরসংলগ্ন। সাহিত্যবিচারে ইতিহাসের স্থান বিবেচনা ও ইতিহাসবিচারে দ্বান্দ্বিকতার প্রয়োগ—এরা যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, ততটা গুরুত্ব পায়নি। নান্দনিক বিচারটাই মুখ্য হয়ে রয়েছে। এর পেছনের ঘটনাটা হলো জ্ঞানচর্চার দুর্বলতা। জ্ঞানের চর্চা উৎসাহ পায়নি। বিশেষভাবে দর্শনচর্চা অবহেলিতই থেকেছে।
সাহিত্য-সমালোচনা বলে নয়, সাহিত্যের নিজেরই মূল্য কমে গেছে। সমাজে বস্তুগত উন্নতি ঘটেছে, কিন্তু সেই উন্নতি পুঁজিবাদী ধরনের। এই উন্নতি মুনাফা চেনে, সংবেদনশীলতা বোঝে না। সাহিত্য তো বস্তুগত মুনাফা দেবে না, দেবে অন্তর্গত আনন্দ, বিকশিত করবে সংবেদনশীলতাকে। ভোগবাদিতা এসেছে, এসেছে স্থূল বিনোদন। সাহিত্য তো স্থূল বিনোদনের সামগ্রী নয়। দুরন্ত তৎপরতা চলছে মিডিয়ার। মিডিয়া জগৎটাকে বড় করতে গিয়ে ছোটই করে ফেলেছে। ছোট পর্দায় আমাদের আটকে রাখছে। যেমন ধরা যাক চলচ্চিত্র। সেটা তো সামাজিকভাবে উপভোগ করার জিনিস, এখন প্রায় সবাই
তো সিনেমা দেখছে ব্যক্তিগতভাবে, যেন লুকিয়ে লুকিয়ে।
ঢাকায় তো আমরা ছিলাম একটা মফস্বলীয় পরিবেশে। বাইরে গিয়ে বিভিন্ন চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচয়টা বেড়েছে। মার্ক্সীয় চিন্তার বিষয়ে আগ্রহটা আগেও ছিল, কিন্তু পরিচয়ের সুযোগ ছিল সীমিত। লিডসে গিয়ে সুযোগটা বাড়ল। সাহিত্য ও ইতিহাসের ভেতর থেকেই রচিত, এটা তো জানতামই; কিন্তু ইতিহাসে যে অর্থনীতি থাকে, থাকে শ্রেণিবিভাজন ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব—এই জ্ঞানটা মার্ক্সবাদ আমাকে বিশেষভাবে দিয়েছে। লেখক যতই নিরপেক্ষ হোন না কেন, সমাজের দ্বন্দ্বগুলো তাঁর ওপরে প্রভাব ফেলবেই। তিনি না চাইলেও তাঁর একটি মতাদর্শিক অবস্থান সৃষ্টি না হয়ে উপায় নেই। মতাদর্শটা সাহিত্যে সব সময়ই থাকে। আসলে কোনো সাহিত্যই আদর্শনিরপেক্ষ নয়। মার্ক্সবাদ ইতিহাসের ব্যাপারে ঔৎসুক্য এবং মতাদর্শের প্রশ্নে কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। ব্যক্তিগতভাবে আমার মধ্যেও সেটা ঘটেছে।
তবে সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা যে ধারায় বিকশিত হওয়াটা প্রত্যাশিত ছিল, সেই ধারায় ঘটেনি। কথা ছিল আমরা মুক্তি পাব। মুক্তি পাব আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার কবল থেকে। সেটা পাইনি। রাষ্ট্র বরং আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অধিক আমলাতান্ত্রিক এবং বৈষয়িক সব উন্নতির একই রাস্তা, পুঁজিবাদী। এ ব্যবস্থায় ব্যক্তি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং আত্মস্বার্থপর হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র সমালোচনা সহ্য করে না। সমাজ ইহজাগতিকতা থেকে পশ্চাতে সরছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে পড়েছে। মিডিয়া স্বাধীন মত প্রকাশকে উৎসাহ দেয় না, নীরবে তার কণ্ঠরোধ করে। সার্বিক এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদ এখন অত্যন্ত ক্ষীণ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সংস্কৃতি
- পুঁজিবাদ
- শিল্প-সাহিত্য