বৈষম্যমূলক শিক্ষা পদ্ধতি ও ঢাবির ক্রমাবনতি
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমেই একটা উচ্চতর মাদ্রাসায় রূপ নিচ্ছে।’ বেশ কয়েক বছর আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামখ্যাত ইতিহাসের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল এ মন্তব্য করেছেন। ইতিহাসের অধ্যাপকের কথাটি দেশের বৈষম্যমূলক শিক্ষা পদ্ধতিকেও নির্দেশ করে। মন্তব্যটি সাধারণ মানুষের মনে সে সময় আলোড়ন না তুললেও সাম্প্রতিক সময়ে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। দেশবাসীর অহংকারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এ ধরনের আলোচনার প্রেক্ষাপট চিন্তারই বিষয়। এটা যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ এমনটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। দেশের আরও যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেগুলোও যে এর বাইরে তা ভাবা যাচ্ছে না। বিশ্বাস করি, ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকেই তিনি এর আগেও এ ধরনের বক্তব্য রেখেছিলেন। গত কয়েক বছরে পরিবেশের আরও অবনতি ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের অবনতি হয়েছে, ব্যবস্থাপনার অবনতি হয়েছে সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষেরও দ্বিমত নেই।
সাধারণ শিক্ষাকে ক্রমাগতভাবে মানহীন করার ক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারকরা একটা সুযোগও হাতছাড়া করছেন বলে মনে হয় না। শিক্ষার উন্নয়নে যেসব ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে তার বাহ্যিক রূপগুলোকে যদি একটার পর একটা সাজানো হয় তাহলে বোধ করি আর কোনো মন্তব্য করার প্রয়োজন পড়ে না। যেকোনো পদক্ষেপের পরপরই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত পেশাজীবীদের অংশ হিসেবে শিক্ষকসমাজ আহা-বেশ-বেশ-বেশ বলে লাফালাফি শুরু করে থাকেন। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার মানসিকতার মধ্যে তারা থাকতে পারছেন না। অথচ ভাষা, সংস্কৃতি, গণতন্ত্র, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতা কত না উজ্জ্বলতর ঘটনার সাক্ষী আমাদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা না থাকলে শিক্ষার্থীরা এই বিশাল কর্মযজ্ঞে নিজেদের এমনভাবে সামনে নিয়ে আসতে পারত না। কিন্তু আজকে মারামারি, হানাহানি, চাঁদাবাজি, দলবাজির কাছে অতীত হারিয়ে গিয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ছিল তা স্থবির হয়ে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বত্র ভর্তি পদ্ধতিতে এমন সব ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়নের সুযোগ আছে বলে বিশ্বাস করা যায় না। সর্বপ্রথম বিবেচনায় আনা প্রয়োজন সবার জন্য উচ্চশিক্ষা দেশ ও জাতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে বলতে হয় মানবসম্পদ পরিকল্পনা না থাকার কারণে আমরা কেউ জানি না আমাদের প্রয়োজনীয়তার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যাকালীন কোর্সের প্রতিযোগিতা দেখলে সাধারণ মানুষের বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। বিশাল কোচিং সাম্রাজ্য, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সাধারণ শিক্ষা-মাদ্রাসা শিক্ষার বিভক্তি ইত্যাদি কারণ বিবেচনায় না নিয়ে পরিস্থিতি বোঝা অবশ্য কঠিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন অধ্যাদেশ-১৯৭৩-এর সুযোগ নিয়ে শিক্ষকরা দেশ ও জাতির কল্যাণের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারতেন। মেধাবী, যোগ্য শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা ঘটাতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে দেওয়া যেকোনো নির্দেশ উপেক্ষা করে সর্বোত্তম শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তুলতে পারতেন। জ্ঞানতাপস শিক্ষকদের সামনে রেখে গবেষণার বিশাল ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু তার বদলে সাধারণ মানুষ দেখল উপাচার্য হওয়ার ইঁদুরদৌড়, রাত ১০টায় তালা ভেঙে উপাচার্যের চেয়ারে বসা, একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্নীতির খবর, ছাত্রনেতাদের চাঁদাবাজি, শিক্ষক নিয়োগের নামে ভোটার নিয়োগদান কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শে শিক্ষকদের বর্ণিল হয়ে ওঠা। কোটায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী আবার কোটার সুযোগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছেন।