করিডোর-ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভবিষ্যৎ
সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক পৃথক এসএমভিটি (স্লো মুভিং ভেহিকল ট্রাফিক) লেনসহ চার লেনে উন্নীতকরণ এবং কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়ক নির্মাণ নামে দুটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারত, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত সংযোগসহ উপ-আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ স্থাপন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মানুষ যাতায়াত, পণ্য আমদানি-রফতানি সম্প্রসারণ এবং ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়নাধীন আশুগঞ্জ নদীবন্দর ও আখাউড়া স্থলবন্দর ও ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করাই এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এখানে উল্লেখ্য, ট্রান্সফার ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড লজিস্টিক স্টাডি (বিটিআইএলএস) নামের এক সমীক্ষায় ভারতসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে আটটি করিডোর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ আঞ্চলিক সংযোগকে গুরুত্ব দিয়ে সিলেট-তামাবিল ও কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। দিন কয়েক আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার আলোকে বাংলাদেশকে বিনা শুল্কে ভারতের স্থল, বিমান ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য পরিবহনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশের তালিকায় প্রবেশ করার দিকে যাচ্ছে এবং ইউরোপে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি নজিরবিহীন সংকটের মধ্যে আছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে একনেকে সিলেট-তামাবিল ও কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়ক ঘিরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অনুমোদন বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ ভূরাজনৈতিকভাবে বিশেষ তাত্পর্য বহন করে।
বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির এ যুগে একমাত্র ফলপ্রদ ও সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থাই কেবল ভূরাজনৈতিক ও আর্থসামাজিকভাবে একটি অঞ্চলের চেহারা আমূল বদলে দিতে পারে, যার প্রমাণ ইউরোপ, আমেরিকা ও আসিয়ান অঞ্চলের উন্নত দেশগুলো। বিশ্বের দ্রুত, সহজ, নিরাপদ ও সমন্বিত সড়ক-মহাসড়কের প্রায় সবই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সৌদি আরব, কানাডা ও ইউরোপের ধনী অর্থনীতির দেশগুলো। অন্যদিকে বিশ্বের ধীরগতির সব সড়ক মূলত দরিদ্র দেশগুলোয়, যা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে মূল অন্তরায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২০২২ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির সড়ক পাহাড়ি দেশ ভুটানে, যেখানে গাড়ির গড় গতি ঘণ্টায় ৩৮ কিলোমিটার। এরপর নেপাল ও পূর্ব তিমুর ৪০ কিলোমিটার। তৃতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ ও হাইতির সড়কে গড় গতি ঘণ্টায় মাত্র ৪১ কিলোমিটার। দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকার ৫০, আফগানিস্তান ৫৭, ভারত ৫৮ এবং পাকিস্তানের ৮৬ কিলোমিটার। এ রকম প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি একনেক বাংলাদেশের দুটি মহাসড়ক উন্নয়নের প্রকল্প বাস্তবায়নের সবুজসংকেত দিয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সীমান্তের বিভিন্ন করিডোরের মাধ্যমে বাংলাদেশ দিয়ে ভারত, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা এবং ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এবং এ অঞ্চলের দেশগুলো অনেক দিন ধরেই স্থলবেষ্টিত বা প্রায় স্থলবেষ্টিত দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে ট্রানজিট সেবার জন্য ১৫টি আলাদা করিডোর বিবেচনা করছে এবং নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। ভূপ্রাকৃতিক গঠনের কারণে বাংলাদেশের ট্রানজিট মূলত দুটি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রথমত ভুটান, চীন, নেপাল ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং দ্বিতীয়ত কলকাতা হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং মিয়ানমার ও চীনে পণ্য পরিবহনের জন্য করিডোর হিসেবে বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও নৌপথের ব্যবহার। এ লেখায় আন্তঃদেশীয় সমন্বিত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার কয়েকটি দিক বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে।