বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন এবং আজকের বাস্তবতা
১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের ৬০ বছর পূর্তি আজ। সেদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ম্ফূর্ত ব্যতিক্রমী আন্দোলন গড়ে তোলেন। আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হয়েই শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগের সচিব ও আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর প্রাক্তন শিক্ষক এসএম শরীফকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করেন। শিক্ষার উন্নয়নে শরীফ কমিশনের অর্থসংস্থান সম্পর্কিত প্রস্তাব ও মন্তব্য ছিল- 'শিক্ষা সস্তায় পাওয়া সম্ভব নয়।' তারা মনে করে, অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল ও নামমাত্র বেতনের মাধ্যমিক স্কুল স্থাপনের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করাই জনসাধারণের রীতি। শরীফ কমিশনের যে সুপারিশ বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনকে তীব্রতর করে তা হলো, ২ বছর মেয়াদি স্নাতক কোর্সকে ৩ বছর মেয়াদি করার সুপারিশ। ছাত্রসমাজ শরীফ কমিশনের প্রতিবেদনকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতি হিসেবে চিহ্নিত ও মূল্যায়ন করে। শিক্ষা সংকোচনমূলক গণবিরোধী এ প্রতিবেদন তারা প্রত্যাখ্যান করে।
ছাত্ররা আগে থেকেই আইয়ুব খান তথা সামরিক আইনবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন। এমন একটা অবস্থায় শরীফ কমিশনে গণবিরোধী সুপারিশ ছিল ভিমরুলের চাকে ঢিল ছোড়ার মতো। তারা অত্যন্ত সাংগঠনিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরের ছাত্ররা স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। প্রথম আন্দোলন শুরু হয়েছিল ঢাকা কলেজ থেকে। ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাস কোর্সের বিপক্ষে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা সর্বপ্রথম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ডিগ্রির ছাত্র প্রতিবন্ধী এমআই চৌধুরী এ আন্দোলনের সূচনা করেন। উচ্চ মাধ্যমিকে ইংরেজিকে অতিরিক্ত বোঝা মনে করে উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন শুরু করে। ওই সময় আমি ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং আন্দোলনের একজন সংগঠক ছিলাম। শিক্ষা কমিশনের কয়েকটি সুপারিশের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন গড়ে ওঠে। কয়েক মাস ধরে চলা এ আন্দোলন শুরু করেছিল ঢাকা কলেজের ছাত্ররা। এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে একের পর এক ধর্মঘট, ক্লাস বর্জন ও অনশন ধর্মঘট চলছিল। সেই ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় যে মিছিল হয়, তাতে শুধু ছাত্রছাত্রীরাই অংশ নেয়নি; এর পাশাপাশি কলকারখানার মজুর, রিকশাচালক, মাঝিরাও মিছিলে শরিক হয়। ১৯৬২ সালের সে আন্দোলন নিয়ে আসে প্রগতিশীলতা। বাইরের কোনো মহলের প্রভাব ছাড়াই ছাত্রছাত্রীরা এ আন্দোলন শুরু করেছিল।
বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে শিক্ষায় ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে সমাজে বৈশিষ্ট্যগত লক্ষণীয় রূপান্তর ঘটেছে। ষাটের দশকে উচ্চশিক্ষা সীমিত ছিল স্বল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে। এমনকি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় বেশিরভাগেরই প্রবেশগম্যতা ছিল না। বর্তমানে সাক্ষরতার হার শুধু নয়; উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সম্প্রসারণ, বিশেষায়িত শিক্ষা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য শিক্ষার সুযোগ তৈরি হওয়া বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই সঙ্গে শিক্ষার কারিকুলাম ও পাঠদান ব্যবস্থায় সূচিত হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জাতীয় শিক্ষানীতি
- শিক্ষা আন্দোলন