মহাপ্রাণ সুন্দরবন রক্ষার লড়াইয়ে কার পরাজয়
সুন্দরবনের বিপৎসীমার মধ্যে একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে—এটা জানার পর প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ আমরা কজন প্রথম রামপাল যাই ২০১০ সালের শেষ দিকে। নদী পার হয়ে প্রকল্পের সাইনবোর্ড দেখি। কথা বলি গ্রামের কৃষক নারী-পুরুষের সঙ্গে। এক বাড়ির মানুষ আমাদের নিয়ে তাঁদের দাওয়ায় নদীর মাছ দিয়ে ভাতও খাওয়ান। বেশির ভাগ গরিব কৃষক, বললেন—কোনো কাগজপত্র ছাড়াই এলাকা থেকে চলে যাওয়ার চাপ আসছে। কখনো পুলিশ, কখনো সন্ত্রাসী এসে হুমকি দিচ্ছে।
আমরা এই প্রকল্পের লাভ–ক্ষতি বিষয়ে আরও খোঁজখবর নিলাম, দেখলাম এই ভয়াবহ প্রকল্প না থামালে পুরো দেশের জন্যই বিপদ। এলাকায় আবার গেলাম লোকজনকে নিয়ে কথা বলতে। সন্ত্রাসীরা আমাদের ঘেরাও করল। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে যোগাযোগ করে এলাকায় সমাবেশ ডাকলাম। গিয়ে দেখলাম, পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করেছে, যাওয়া যাবে না। ওই এলাকায় মানুষের কথা শোনা–বোঝাই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। এসব বাধার মুখে নানাভাবে এলাকার ভেতরে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের খবরাখবর পৌঁছানো গেল। এর ফলে যে এলাকায় দাঁড়ানোই যাচ্ছিল না, সেখানে ২০১৩ সালে মাইলের পর মাইল লংমার্চ নিয়ে গেলাম। দুই পাশ থেকে হেঁটে, ভ্যানে, সাইকেলে, ভেতরের এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষ রাস্তায় এসে আমাদের স্বাগত জানালেন। তারপর আমরা কতবার গেছি, তার হিসাব নেই। পুলিশি হামলা, বাধা, হুমকিও কম ছিল না।
এর মধ্যে মহাপ্রাণ সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন জানা–অজানা অসংখ্য মানুষ। জাতীয় কমিটির সংগঠিত কর্মসূচির পাশাপাশি এই আন্দোলনে কত মানুষ যে কতভাবে শ্রম ও সময় দিয়েছেন, তার সংখ্যা আমার পক্ষেও বলা সম্ভব নয়। গায়ে–গতরে খেটে, প্রাণের টানে নিজের জীবন ও জীবিকাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে অসংখ্য মানুষ নিজ নিজ ক্ষমতা ও আকাঙ্ক্ষা থেকে যেভাবে সুন্দরবন তথা দেশের জন্য দাঁড়িয়েছেন, তা এক নতুন দিশা আর বিশাল ভরসার জায়গা তৈরি করেছিল। শিশুরা ছবি এঁকেছে, গান গেয়েছে, ছবি এঁকেছেন তরুণ শিল্পীরা, নতুন নাটক তৈরি হয়েছে, নাট্যকর্মীরা নাটক নিয়ে পথে পথে ঘুরেছেন, গানের শিল্পীরা নতুন নতুন গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন। আমাদের তালিকায় ৪০টির বেশি গান আছে এখন, নতুন শিল্পীও তৈরি হয়েছে, তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে, লেখক-বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞরা কাজ করেছেন। সক্রিয় থেকেছে জনপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন, নারী সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, পাঠচক্রসহ তরুণেরা।