বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন? আমি জানি এর খুব সহজ উত্তর কারও কাছে নেই। দুটি দেশের মধ্যে আসলে সম্পর্ক হয় দুই স্তরে। একটি সরকারের সঙ্গে সরকারের, অন্যটি দুই দেশের জনগণের মধ্যে। সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে যাওয়ার আগে একটু দেখে নিই দুই দেশের জনগণের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস, সম্প্রীতির সম্পর্ক কতটা। কয়েক বছর আগে সিএনএন, আইবিএন এবং দ্য হিন্দু যৌথভাবে একটি জরিপ পরিচালনা করেছিল, যার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল অন্যান্য দেশ সম্পর্কে ভারতের নাগরিকদের মনোভাব। সেই জরিপে একটি প্রশ্ন ছিল, ভারত কোন কোন দেশকে তার বিশ্বস্ত বন্ধু ভাবতে পারে। এর উত্তরে সর্বাধিক অর্থাৎ ৪৮ শতাংশ ভারতীয় জানিয়েছিল তাদের বিশ্বস্ত বন্ধু বাংলাদেশ। আমি ভাবছিলাম, এই একই প্রশ্নের উত্তরে ঠিক কত ভাগ বাংলাদেশি ভারতের নাম বলবে?
বাংলাদেশের মানুষের চোখে ভারত আমাদের যেমনই বন্ধু হোক, একটি বিষয় তো কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। আর তা হলো, ভারত আমাদের তিনদিক বেষ্টন করে রাখা প্রতিবেশী রাষ্ট্র। সব পরিবর্তন সম্ভব, কিন্তু প্রতিবেশী? ‘নৈব নৈব চ’।
আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে বাংলাদেশে সবসময়ই ভারত নিয়ে চোখে পড়ার মতো এক ধরনের আহ্লাদি আদিখ্যেতা সরকারি পর্যায়ে লক্ষ করা যায়। সেটা ভালো লাগতো যদি আহ্লাদের কারণে দেশের স্বার্থ রক্ষা হতো। কখনও বলা হয় ‘স্মরণকালের সবচেয়ে ভালো বন্ধু’, ‘স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্ক’, ‘রক্তের রাঁখিবন্ধনে আবদ্ধ’, আবার কখনও বলা হয় ‘প্রতিবেশীদের জন্য শিক্ষণীয় মডেল সম্পর্ক’, কিংবা ‘দুই ভাই’। এই ধরনের কথা স্বাভাবিকভাবেই দেশের মানুষের ভেতর এক ধরনের প্রত্যাশা তৈরি করে, যেটি পূরণ না হলে বৈরিতা বাড়ে শতগুণ।
২০১৮ সালে একবার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ভারতকে যা দিয়েছি সেটি তারা মনে রাখবে আজীবন। এই কথার পিঠে অবধারিতভাবে প্রশ্ন ওঠে, এই দেওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশ পেলো কি? ২০১৮ সালের ২৬ মে দুই দিনের ভারত সফরের সময় ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশ ভারতের কাছে প্রতিদান চায়’। এই সফর শেষে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করলে সেখানে তাকে প্রশ্ন করা হয় তিনি কোনও প্রতিদান চেয়েছেন কিনা। এর উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কোনও প্রতিদান চাই না। প্রতিদানের কী আছে? আর কারও কাছে পাওয়ার অভ্যাস আমার কম। দেওয়ার অভ্যাস বেশি।’ কথাগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে শুনতে যত মধুরই লাগুক না কেন, দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক আদতে নির্ধারিত হয় বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, কৌশলগত, ভূ-রাজনৈতিক নানা দেনা-পাওনার নিরিখে। দুই রাষ্ট্রের সম্পর্ক কোনও চ্যারিটি নয় যে ‘আমার এই দিয়ে যাওয়াতেই আনন্দ’ রীতিতে চলবে। সুতরাং প্রতিবার দুই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সফর শেষে যখন বাংলাদেশের মানুষ দেনা-পাওনার হিসাবের খাতা খুলে বসে, তখন হতাশ না হয়ে পারে না।