প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর যেন শুধু আনুষ্ঠানিকতা না হয়
এই লেখা যখন পাঠকের হাতে যাবে তার পরদিনই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের ভারতের রাজধানী দিল্লি সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। ২০১৯ সালের পর এই প্রথম শেখ হাসিনা দিল্লি সফর করছেন। ২০১৯ সালের সফরটি ছিল মূলত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে যোগ দেওয়ার জন্য। সঠিক অর্থে সেটি কোনো রাষ্ট্রীয় সফর না হলেও দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ কিছু দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল।
তবে সেই সফরের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিল্লির বিমানবন্দরে সঠিক প্রটোকল মেনে সম্মান জানানো হয়নি বলে অনেকে মনে করেন। শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে একজন জুনিয়র মন্ত্রী অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, যা অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু ঠেকেছে। তবে এবার সরকারি প্রেস নোটে জানানো হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানাবেন এবং তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আনুষ্ঠানিক গার্ড অব অনার দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ও ভারত দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও যখন দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকও হয়, তখন তা বেশ কিছুটা বাড়তি গুরুত্ব পায়, যার অন্যতম কারণ এই দুটি দেশ শুধু যে প্রতিবেশী তা-ই নয়, এই দুটি দেশের মধ্যে বেশ কিছু অভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। তার সঙ্গে আছে বেশ কিছু দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অমীমাংসিত সমস্যা, যার মধ্যে দুই দেশের ভেতর দিয়ে প্রবহমান কিছু অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, যার মধ্যে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি ঝুলে আছে কয়েক দশক ধরে। প্রতিবারই যখন এক দেশের উঁচু পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা অন্য দেশ সফর করেন, মানুষের মনে আশা জাগে এবার বুঝি এই সমস্যার সমাধানের পথ খুলল। শেষতক তেমন কিছুই হয় না। বাংলাদেশের মানুষ আবার হতাশ হয়।
গত ৫০ বছরে উভয় দেশের সরকারপ্রধানরা একাধিকবার বৈঠক করেছেন এবং উভয় পক্ষের সদিচ্ছার কারণে দীর্ঘদিন জমে থাকা অনেক কঠিন সমস্যারও সহজ সমাধান হয়েছে। এই দুই দেশের বেশির ভাগ সমস্যার উৎপত্তি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের নামে যখন বাংলা ভাগ হলো। বাংলা ভাগ কতটুকু যৌক্তিক ছিল সেই বিতর্ক এখনো চলছে। তবে ইতিহাসকে তো আর পেছনে নিয়ে যাওয়া যায় না। তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানেও পানিবণ্টন বিষয়ে বড় ধরনের সমস্যা ছিল। ১৯৬০ সালে এক চুক্তির বলে এই সমস্যার সমাধান হয়েছে (Indus Water Treaty)। এই সমস্যার সমাধান না হলে করাচি বন্দর অনেকটা অচল হয়ে যেত। একটি বিস্তীর্ণ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হতো। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আগে থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব অমীমাংসিত সমস্যা রয়ে গিয়েছিল, সেসবের কোনোটিরই সমাধান করার চেষ্টা করা হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের দিকে নজর দেওয়া শুরু হয়। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে ২৫ বছরমেয়াদি এক মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং একই সঙ্গে অভিন্ন নদী কমিশন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যার লক্ষ্য হচ্ছে দুই দেশের ভেতর দিয়ে প্রবহমান অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন যেন সুষ্ঠু ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে হয়। এ সিদ্ধান্তও হয় যে দুই দেশ একসঙ্গে পানিসম্পদের ব্যবহার এবং বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজ করবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সামরিক শাসক জিয়া ক্ষমতা দখল করলে তাঁর পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্রই ছিল ভারতবিরোধিতা। তখন থেকেই বলা হয়ে থাকে, এই ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি হচ্ছে একটি গোলামি চুক্তি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই তথাকথিত গোলামির চুক্তি বাতিল করার সাহস বিএনপির কখনো হয়নি।