ত্বকী হত্যার বিচার কেন চাই
ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে আমরা সমবেত হই বছরের পর বছর ধরে এবং প্রতিবছরই আমাদের অনুভূতি হয় এ রকমের যে আমরা অপরাধী। এই কিশোরকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। আমরা যে কেবল ত্বকী হত্যার বিচার চাই, তা নয়। আমরা এটাও চাই যে ত্বকীরা যেন সমাজে বাঁচতে পারে। তাদের যে মেধা, তাদের যে সম্ভাবনা, তাদের জ্ঞানানুশীলনের যে আগ্রহ, সেগুলো যেন তারা বিকশিত করতে পারে।
ত্বকীকে আমি প্রতীক হিসেবে দেখতে পাই। বাংলাদেশের কিশোরদের একজন প্রতীক। যে কিশোর গান গায়, পড়াশোনা করে, সুধীজন পাঠাগারে নিয়মিত যায়, আন্দোলনে থাকে, মিছিলে যায় এবং স্বপ্ন দেখে, এই অন্যায়ে ভরা সমাজ, জগৎটাকে সে বদলাবে। ত্বকীকে আমি সেই কৈশোরের, সেই অঙ্গীকারের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে পাই।
আবার তার ওপরে যে আক্রমণ হয়েছে, সে যে বাঁচতে পারল না, এত অল্প বয়সে কৈশোরেই সে ঝরে গেল, সেটাও একটা প্রতীক। যেন আলোর সঙ্গে অন্ধকারের যে দ্বন্দ্ব বাংলাদেশে চলছে, তারই প্রতীক। তো আমরা এই দুটো সত্যের মধ্যে আছি। এই যে কিশোরেরা আছে, আলো আছে, ত্বকী আছে, আবার অন্ধকার আছে; যে অন্ধকার ত্বকীকে গ্রাস করে ফেলেছে। প্রশ্ন হলো, এই দুইয়ের মধ্যে কোনটা জয়ী হবে। আমরা ত্বকীর মৃত্যুর কথা স্মরণ করি তখন, বিশেষভাবে এই প্রশ্নটাই সামনে আসে যে কে জয়ী হবে বাংলাদেশে। আলো, নাকি অন্ধকার?
আমরা তো দীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম করে এসেছি। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে এই দ্বন্দ্বটা রয়ে গেছে। আমরা আমাদের চতুর্দিকে এখন যেটা দেখতে পাচ্ছি, সেটা হলো একটা ভীতি। মানুষ একটা ভয়ের মধ্যে আছে। নানান রকমের ভয়। তার নিরাপত্তা নেই, মেয়েদের নিরাপত্তা নেই, জীবিকার নিরাপত্তা নেই, চলাফেরার নিরাপত্তা নেই। রাস্তায় বেরোলে গাড়িচাপা পড়ে মারা যায়, হত্যাকাণ্ড হয়, জিনিসপত্রের দাম অসম্ভব বাড়ছে। এ ছাড়া কোন কথা বলে বিপদে পড়বে—এই ভয়ও আছে। অন্যদিকে আবার এসব ভয়ের কারণে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। ভয়ের আরেকটা কারণ হচ্ছে বিচার নেই। বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে।একদিকে ভীতির সংস্কৃতি, আরেকদিকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এ কারণে একটা হতাশা দেখা দিচ্ছে যে আমরা বোধ হয় পরাজিত হয়ে গেছি।আরেকটা কথা আমার খুব মনে পড়ে। নারায়ণগঞ্জ শহর ছিল সংস্কৃতির প্রতীক, খেলাধুলার প্রতীক। আমরা কৈশোরে, যৌবনে ওই শহরে যাতায়াত করতাম ঢাকা থেকে।
আমরা আনন্দিত হতাম ওই সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে, নদীর ধারে গিয়ে। নারায়ণগঞ্জ বিখ্যাত ছিল খেলাধুলার জন্য। সেই নারায়ণগঞ্জের যে দুর্দশা আজকে হয়েছে, সেই দুর্দশা আমাদের বাংলাদেশেরই প্রতীক।
আজ বাংলাদেশে কিশোরেরা যে অবস্থায় আছে, তারও একটা প্রতীক এখানে আমরা দেখতে পাই। এখানে কিশোর বেঁচে থাকতে পারে কোনোমতে। কিন্তু সেই বেঁচে থাকা কিশোরের মতো বেঁচে থাকা নয়। কিশোরদের জীবনে আনন্দ নেই, বৈচিত্র্য নেই, খেলাধুলা নেই। কিশোরেরা এখন অপরাধীতে পরিণত হচ্ছে, মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে এবং কৈশোরেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর কৈশোর নষ্ট হয়ে যাওয়া মানেই হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাওয়া। এই জায়গাটাও আমাদের দেখতে হবে। নারায়ণগঞ্জ শহর যেভাবে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল, কৈশোর চলে গেল। এটা হচ্ছে পুরো বাংলাদেশের চিত্র। কিন্তু এর বিরুদ্ধেই আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে। আমাদের ভরসার জায়গা কিন্তু কিশোরেরাই।
আমি আরেকটি বিষয় দেখতে পাই। সেটা হচ্ছে, ত্বকী একটা পাঠাগারে যাচ্ছিল। সেই পাঠাগার থেকে সে বই আনবে। আনার পথে দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা করল। এটাও একটা প্রতীকের মতো মনে হয়, আমাদের দেশে সংস্কৃতিচর্চা কেমন বিপদের মধ্যে আছে, কেমন একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে, কেমনভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এখন যদি আমরা হতাশ না হতে চাই, যদি আমরা পরাজিত না হতে চাই, যদি আমরা আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে চাই, তাহলে আমাদের কর্তব্য হবে দেশে একটা সাংস্কৃতিক জাগরণ তৈরি করা। লক্ষ্যটা হবে ওই যে মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, যে চেতনা আমাদের আদি সংবিধানে লেখা ছিল রাষ্ট্রীয় চারটি মূলনীতির মধ্যে, তার বাস্তবায়ন করতে হবে তো বটেই।
আরও বেশি করে যেটা করতে হবে সেটা হলো, একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটানো। সেই বিপ্লব বাংলাদেশে ঘটেনি। আমরা ব্রিটিশ আমলে যে ব্যবস্থার মধ্যে ছিলাম, পাকিস্তান আমলে তার চেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে ছিলাম, আজ বাংলাদেশে কি আমরা খুব ভালো আছি? ওই যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়ে গিয়েছিল ইংরেজরা; জমিদার ও প্রজার সেই সম্পর্কটাই পুনঃ উৎপাদিত হচ্ছে নানা ক্ষেত্রে। কেউ বিত্তবান, কেউ মনিব; অন্যরা বিত্তহীন, সুযোগবঞ্চিত, প্রজার মতো আছে। সেই জায়গাতে আমরা পরিবর্তন আনতে পারিনি। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের তাড়িয়েছি, কিন্তু ওই যে সম্পর্ক, মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক, যে মানবিক সম্পর্ক, সাম্যের সম্পর্ক, অধিকার-সুযোগ ও সমতার যে সম্পর্ক, সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি।