সতর্কতার সঙ্গে আত্মশুদ্ধি প্রয়োজন
অতি সম্প্রতি রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের বাদ-প্রতিবাদের ভাষা ও বয়ানে বোঝা যায় নির্বাচন ভাবনা ছড়িয়ে পড়েছে। সবচেয়ে লক্ষণীয়, এ সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থান থাকার পরও হঠাৎ যেন কিছুটা হতাশা পেয়ে বসেছে আওয়ামী লীগ নেতাদের। বিরোধী দলগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়ায় সম্ভবত কোনো চ্যালেঞ্জ অনুভব করছিল না আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ সরকার। দুর্নীতিগ্রস্ত মানসিকতার নেতারা যেন একটি অদৃশ্য বলয় তৈরি করে রেখেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চারদিকে। তাই হয়তো বাস্তবতা কিছুটা আড়ালে ছিল। দুর্নীতি ও উগ্র দলীয়করণের ঘুণপোকা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে দলটিকে তা হয়তো অনেকের কাছে অতটা স্পষ্ট ছিল না। এ ধরনের অসুস্থতা মনের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলে। তাই বিএনপি সফলভাবে কয়েকটি প্রতিবাদ আন্দোলন করার পর এক ধরনের হতাশার ছাপ দেখা দিতে থাকে আওয়ামী লীগ সরকারের মুখপাত্রদের প্রতিদিনকার বক্তব্যে।
আমার এক বিএনপিপন্থি সহকর্মী দিন-কয়েক আগে টেলিফোন করলেন। বললেন, আপনাদের আমলের গুম-খুন নিয়ে তো জাতিসংঘের মানবাধিকার নেতারা জোরেশোরে মুখ খুলেছেন। বুঝলাম বরাবরের মতো আমাকে একটু খোঁচা দেওয়ার মওকা পেয়েছেন। বন্ধুটি যদিও জানেন আমি কোনো রাজনৈতিক দলের অন্ধ সমর্থক নই। শিক্ষক রাজনীতির সমালোচক। তবু তিনি আমাকে আওয়ামী লীগ সমর্থক বিবেচনা করেন। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব অধিকাংশ কিশোরের মতো বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশাল আবেগ বুকে নিয়ে বড় হয়েছি। এ সময় কিছুসংখ্যক পাকিস্তানপন্থি বাদ দিলে এ দেশের সিংহভাগ মানুষই বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির মুখে আমরা নারায়ণগঞ্জের বাড়ি ছেড়ে জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম বিক্রমপুরের গ্রামের বাড়িতে। পাকিস্তানি সৈন্য, বিহারি আর স্থানীয় পাকিস্তানপন্থিরা আগুনে ছাই করে দিয়েছিল আমাদের সাজানো বাড়ি। কিন্তু অনেকের মতোই এ নিয়ে বাড়ির বড়দের কোনো আফসোস করতে দেখিনি। সবারই বিশ্বাস ছিল দেশ স্বাধীন হবে। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন। আবার এ দেশ ফুলে-ফলে সেজে উঠবে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রশ্নাতীত শ্রদ্ধা আর বঙ্গবন্ধুকন্যার দেশকল্যাণে নিরলস কাজ করার প্রতি ভালো লাগা ছাড়া এখন আওয়ামী লীগের জন্য বিশাল আবেগ কাজ করছে তেমন নয়। কিন্তু নির্বাচনী সমর্থন দিতে হলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পক্ষকে নিশ্চয়ই সমর্থন দিতে পারি না।
এসব কারণেই সম্ভবত আমার বিএনপিপন্থি সহকর্মী বন্ধু আমাকে আওয়ামী লীগভক্ত বানিয়ে খোঁচা দেওয়ার চেষ্টা করেন মাঝেমধ্যে। আওয়ামী লীগের আমলের দুর্নীতির কথা বিএনপিপন্থি বন্ধু বলতে ছাড়বেন কেন! এখনো সুযোগ পেলে শোনান রিজেন্ট হাসপাতাল আর এর চেয়ারম্যান জনৈক মো. সাহেদের দুর্নীতির খতিয়ান আর কুয়েতে ধরা পড়া দুর্নীতিবাজ এমপি পাপুল প্রসঙ্গ। এ দুজনই আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট ছিলেন। যাদের একজন প্রতারক হিসেবে একাধিক মামলার আসামি। আরেকজন মানব পাচার ও অর্থপাচারের দায়ে কুয়েতি কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন (এখনো আছেন কি না আমি জানি না)।
আমি খুব আতঙ্কের সঙ্গে গত শতকের সত্তরের দশক আর বর্তমান শতকের মধ্যে একটি মিল খুঁজে পাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের নেতারা নিঃস্বার্থভাবে দেশকে এগিয়ে নেবেন এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকেও হতাশ হতে হয়েছিল। স্বার্থপর দুর্নীতিবাজদের কারণে তাকেও বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। ‘চোরের দল’, ‘চাটার দল’ আর ‘চোরের খনি’ বলে তাকেও আক্ষেপ করতে হয়েছিল। এসব কারণে সরকারকে জনপ্রিয়তা হারাতে হয়। সে সময় একটি নীরব জনক্ষোভ যে তৈরি হয়েছিল তা জোর করে আড়াল করতে চাইলেও ইতিহাসের ক্যানভাস থেকে তা মুছে ফেলা যাবে না। এই বাস্তবতা সে সময় আওয়ামী লীগকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আর এর সুযোগে বিএনপির মতো দলের জন্ম হয় এবং জনপ্রিয়তাও অর্জন করে। আবার বিএনপি শাসনামলে এ দলের নেতাদের বড় অংশ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে যায়। তবুও জনগণের শক্তিকে কোনো পক্ষই বিবেচনায় আনতে চায় না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দুর্নীতি
- আত্মশুদ্ধি