চীনা ঋণের ফাঁদ এবং অর্থমন্ত্রীর কথিত বক্তব্য
বিশ্বময় অর্থনীতির খবরাখবর প্রকাশ করার জন্য যে দুইটি পত্রিকা সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে তার একটি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং অপরটি লন্ডন থেকে প্রকাশিত ফাইনান্সিয়াল টাইমস। দুইটি পত্রিকাই বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে অর্থনীতির সংবাদ প্রচার করে। ফাইনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার প্রতিটি রিপোর্টার, গবেষক এবং সাংবাদিকই অর্থনীতি শাস্ত্রে উঁচু মাপের বিশেষজ্ঞ। বিশ্বব্যাপী পত্রিকাটির মানদণ্ড এবং বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষার জন্য প্রতিটি রিপোর্টারকেই সংবাদ বা সাক্ষাৎকার বা নিবন্ধ লেখার ব্যাপারে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় যাতে ভ্রান্ত তথ্য প্রকাশিত হয়ে পত্রিকাটির সুনাম ক্ষুণ্ণ না হয়। ফাইনান্সিয়াল টাইমসের এমনি এক রিপোর্টারের নাম বেন ফ্রাংকলিন। কিছুদিন আগে ফ্রাংকলিন সাহেব ঢাকা এসেছিলেন আমাদের অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল সাহেবসহ আরও কয়েকজন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। মোস্তফা কামাল সাহেবের সাথে সাক্ষাৎকারটি ফাইনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা তাদের অনলাইন ভার্সনে ছেপেছে। পত্রিকাটি দাবি করেছে, সাক্ষাৎকারে মোস্তফা কামাল সাহেব চীন দেশের ঋণের ভিত্তিতে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ (সংক্ষেপে বিআরআই) প্রকল্পে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববাসীকে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহকে, সতর্ক করে বলেছেন- চীনের ঋণ নেওয়ার এবং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পে প্রবেশের পূর্বে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে দুইবার ভাবতে হবে। কারণ বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি এবং প্রবৃদ্ধি ঋণগ্রস্ত উদীয়মান বাজারগুলোতে চাপ বাড়ায়।
ফাইনান্সিয়াল টাইমসের দাবি অনুযায়ী, কামাল সাহেব আরো বলেছেন যে- চীনকে তার ঋণের মূল্যায়নে আরো কঠোর হতে হবে, কারণ দুর্বল ঋণের সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে সংকটে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলছে। পত্রিকার ভাষায় কামাল সাহেব শ্রীলংকার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, সেখানে চীন সমর্থিত প্রকল্পগুলো রিটার্ন জেনারেট করতে ব্যর্থ হয়ে দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে এক গুরুতর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পত্রিকাটি লিখেছে কামাল সাহেবের সতর্কবাণী এই যে বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, সবাইকে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পে সম্মত হওয়ার আগে দুইবার ভাবতে হবে। পত্রিকাটির দাবি অনুযায়ী, কামাল সাহেব আরো বলেছেন- “সবাই চীনকে দোষারোপ করছে এবং চীনও নিশ্চয়ই তার দায় এড়াতে পারে না। চীন থেকে ঋণ নেওয়ার পর ঋণের দায়িত্ব নিজেদেরই নিতে হবে।” পত্রিকাটি আরো লিখেছে যে, অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেবের মতে, “শ্রীলংকার সংকট থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যা হলো কোন প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে ঋণ দেয়া হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে চীন যথেষ্ট কঠোর ছিল না। একটি প্রকল্পে ঋণ দেয়ার আগে সেটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ অধ্যায়ন করতে হবে। শ্রীলংকার পর আমরা অনুভব করেছি যে চীনা কর্তৃপক্ষ এই বিশেষ দিকটির দিকে নজর দিচ্ছে না, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” ফাইনান্সিয়াল টাইমস- এর অনলাইনে প্রকাশিত হওয়ার তিনদিন পর অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল সাহেব ফাইনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের প্রতিবাদ করে লিখেছেন যে, তিনি শুধু চীনা ঋণের কথাই বলেননি, তিনি সাধারণভাবে সকল দেশকে সতর্ক করেছেন যে কোনও সূত্র থেকে ঋণ নেওয়ার আগে সতর্কতা অবলম্বন করতে।
কামাল সাহেবের প্রতিবাদ সত্ত্বেও যা স্পষ্ট তা হলো এই যে, তিনি যদি নাম ধরে চীনের কথা উল্লেখ নাও করে থাকেন তথাপিও যেহেতু তার কথায় বিদেশি ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে সতর্কবাণী রয়েছে, তাই চীনা ঋণের কথা স্বভাবতই এসে যায়। কেননা, গত কয়েক বছর ধরে চীনই হচ্ছে একমাত্র দেশ যে অকাতরে এবং চাওয়ার আগেই আফ্রো-এশিয়া-লেটিন আমেরিকার দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশসমূহকে অকাতরে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে এবং এই চীন থেকে অবিবেচকের মতো অঢেল ঋণ নিয়ে শ্রীলংকা ছাড়াও বেশ কয়েকটি দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশ আজ আর্থিক অনটনের মরণ কামড়ে দিশেহারা, আর চীন হচ্ছে জি-২০ দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণ প্রদানকারী দেশ।
অবিবেচকের মতো ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক বাণী উচ্চারণ যে মোস্তফা কামাল সাহেবই প্রথম করলেন তা নয়। গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের সমস্ত প্রান্তের বহু বোদ্ধা অর্থনীতিক চীনা ঋণের ফাঁদ সম্পর্কে অবারিতভাবে সতর্কতার কথা বলে আসছেন। চীনা ঋণের ভয়াবহতার কথা তারা এমনভাবে বলে আসছেন যে, ‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ কথাটি এখন বিশ্বের শব্দ ভাণ্ডারে একটি নতুন সংযোজন হিসেবে স্থান পেয়েছে। এমনকি নেপাল, যে দেশটির সাথে চীনের ঘনিষ্ঠতা বেশ গাঢ় বলেই সবাই জানেন, সে দেশটিও কয়েক মাস পূর্বে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখের উপরই বলে দিয়েছিলেন যে তারা চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পে অংশ নেবে না, চীনা ঋণ গ্রহণ করবে না। এমনকি চীনের শ্রেষ্ঠতম বন্ধু দেশ পাকিস্তানেও আজ ‘চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে’র নামে নেওয়া চীনা ঋণের বোঝার বিরুদ্ধে সবাই মুখ খুলতে শুরু করেছে। কেননা পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা শ্রীলংকা থেকে বেশি দূরে নয়, যে দেশে এখন ডলারের মূল্য ২৩০ রূপি, যে দেশ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যে দেশে অন্য দেশের কাছে ভূমি এবং অন্য সম্পদ হস্তান্তরের জন্য সরকারকে ক্ষমতা প্রদান করে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। কয়েক মাস পূর্বে জার্মানিতে এক বহুজাতিক সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার সময় আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাহেবও বলেছিলেন চীন আমাদেরকে টাকার বস্তা দেখাচ্ছে। তিনি সেটি গ্রহণ না করার কথা স্পষ্ট করে বলেননি বটে, কিন্তু সে টাকা গ্রহণ করবেন না- এমন ইঙ্গিত তার বক্তব্যে ছিল। কেননা চীন থেকে আমাদের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বহুলাংশেই কমে গেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ফাঁদ
- বৈদেশিক ঋণ
- চীনা প্রতিষ্ঠান