রাঘববোয়ালদের কইয়ের তেলে কই ভাজা
এক সময় লোডশেডিং ছিল এক সমস্যার নাম; মাঝে এটা কিছুদিনের জন্য ছিল নির্বাসনে। এখন আবার তার পুনরাবির্ভাব ঘটেছে; তবে এবার তার মর্যাদা বেড়েছে, এসেছে সমস্যার সমাধান হিসেবে। এই জাতীয় পরিবর্তন হরহামেশাই দেখা যায়। পরিবর্তনশীল এই মহাবিশ্বে আজ যে শত্রু, কাল সে মিত্র। সে যাই হোক, এখন আমরা বিজলির জ্বালার (নাকি জালা বা গহ্বরের) মধ্যে পড়ে গেছি, আর ভ্যাপসা গরমে হাঁপাচ্ছি। এর কারণ অবধারিতভাবে বৈশ্বিক, আমাদের নেতারা সে কথাই জোর দিয়ে বলছেন। তবে কিছু দুষ্ট অর্থশাস্ত্রীরা তার সঙ্গে এক বা একাধিক লেজ জুড়ে দিচ্ছেন, যেগুলোতে নাকি নীতিগত উদ্দংশের সংক্রমণ রয়েছে। অবশ্য এখন যা পরিস্থিতি, তাতে সে লেজের লোমে উকুন অনুসন্ধান না করে সংকট শক্ত হাতে মোকাবিলা করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। মনে হচ্ছে অন্তত কাগজে-কলমে সরকার সে কাজটাই করতে বদ্ধপরিকর।
সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে আট দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এই আট দফা নির্দেশনার মধ্যে পাঁচটিই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহার হ্রাস বিষয়ক; বাকি তিনটি দ্রব্যমূল্য পরিবীক্ষণ, রাজস্ব বাড়ানো ও ক্রয় পরিকল্পনার কলেবর হ্রাস সংক্রান্ত। এই নির্দেশাবলিতে অন্য বিষয়গুলোর বেলায় কৃচ্ছ্রসাধনের কোনো স্পষ্ট উল্লেখ নেই; যেন জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা ও সংকট যে আছে, তার প্রমাণ পুঁজিবাজারের দৈন্যদশা। যেকোনো উন্নত দেশে পুঁজিবাজারকে অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি মনে করা হয়। বিদ্যুতের রেশনিং শুরুর আগেই পুঁজিবাজারের সূচকে পতন দেখা দেয়; ৭ হাজারের ওপর থেকে নেমে এখন সূচক ৬ হাজারের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই অবনমন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কী বার্তা দেবে, তা সহজেই অনুমেয়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন; তিনি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও সর্বস্তরে কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য অনেক আগ থেকে আহ্বান জানিয়ে আসছেন এবং তার শীর্ষ কর্মকর্তারা এই বার্তা অধস্তন কর্মকর্তাদের পৌঁছেও দিচ্ছেন। তবে কর্মকর্তাদের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের ওপর এসবের কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। ইতিমধ্যে নির্দেশ ভঙ্গের অনেক রিপোর্ট সংবাদপত্রে দেখা যাচ্ছে। আবার এই সংকটকালে ভ্রমণভাতার হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকার ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করছে ঠিকই, কিন্তু লোডশেডিংয়ের সময় তার চেয়েও অধিক ব্যয়বহুল জেনারেটর বাসাবাড়িতে ও কলকারখানায় চালু হয়ে যাচ্ছে। তাতে ডিজেলের ব্যবহার আরও বেড়ে যাচ্ছে। মাঝখান থেকে মানুষের ভোগান্তি ও পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এবার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। লোডশেডিং ও বর্ধিত উৎপাদন খরচ দুটোই রপ্তানির গতিকে টেনে ধরবে।
অর্থনীতির প্রতিটা খাত কোনো না কোনো ভাবে বিদ্যুতের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং বিজলি-প্রভাবিত। এজন্য জ্বালানি আর বিজলির পাশাপাশি প্রতিটা খাতে কৃচ্ছ্রসাধন ও দক্ষতা উন্নয়নের নীতি অনুসরণ করা দরকার; প্রধানমন্ত্রীর কৃচ্ছ্রসাধন নীতির স্পিরিটও তাই। কিন্তু যেদিন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সংযম চর্চার হুকুম পাওয়া গেল ঐ দিনই পত্রিকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উদারতার এক অনন্য নজির উন্মোচিত হলো। তাদের হিসাব আলাদা; খেলাপি ঋণ আদায়ে অকর্মণ্য হলেও সুবিধা প্রদানে পারঙ্গম হতে পারলে অন্তত গড়ে দক্ষতার মান সমান্তরালে থাকে! বুদ্ধিমান মানুষের একটি সাধারণ নীতি হলো “If you can’t defeat them, join them”। এই নীতির অনুসরণে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণিকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কথা বলে কর্মে যোগদানের ৫ দিনের মাথায় নতুন গভর্নর ঋণখেলাপিদের জন্য এক নজিরবিহীন সুবিধার সার্কুলার জারি করেন।
সার্কুলারের মর্মার্থ হলো এখন ঋণখেলাপিরা ২.৫ থেকে ৬.৫০ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চতুর্থ দফা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে পারবেন, আগে এর মাত্রা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধ করা যাবে ৫ থেকে ৮ বছরের মধ্যে, আগে মেয়াদ ছিল সর্বোচ্চ ২ বছর। এই কায়দায় খেলাপমুক্ত হয়ে তারা আবার নতুন করে ঋণও নিতে পারবেন। শুধু তাই না, খেলাপিদের কী কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পুরো ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে। আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। পত্রিকায় দেখি দেশে বড় বড় ঋণখেলাপিদের অনেকেই ব্যাংকের মালিক। এই সার্কুলারের মাধ্যমে খেলাপি-অখেলাপি নির্বিশেষে সব মালিকদের জন্য উপভোগ্য সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণের ঝামেলামুক্ত ব্যবস্থা পাকাপাকি করে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই এই ব্যবস্থাকে ‘শুঁটকির হাটে বিড়াল চৌকিদারের’ তুলনা করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিভাবকত্ব কেন এক্ষেত্রে ছেড়ে দেওয়া হলো এমন এক প্রশ্নের জবাবে জনৈক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান যে, এ কাজে সাংঘাতিক তদবির শুরু হয়ে যায়, যেটা সামাল দেওয়া বড়ই কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য যাদের সমস্যা তাদের কাছেই তা চালান করে দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি কৌতুকের কথা স্মরণে এলো। এক বন্ধু আরেক বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নেয় মাসখানেকের মধ্যে পরিশোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। মাসখানেক পর ধারদাতা বন্ধু যখন টাকা ফেরত চায় তখন গ্রহীতা দ্বিতীয় আরেক বন্ধুর কাছ থেকে ঐ টাকা ধার করে তা পরিশোধ করে দেয়। ধার গ্রহীতার সচ্ছলতা না আসায় তিনি এই প্রক্রিয়ায় বেশ কিছুদিন চক্রাকারে কইয়ের তেল দিয়ে কই ভাজার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। এক সময় তার বোধোদয় হয় যে, এই ত্রিভুজ লেনদেনে তার উপস্থিতি একেবারেই অনাবশ্যক; রেললাইনের মতো শান্টিং করে দাতা দুজনকে এক লাইনে লাগিয়ে দিতে পারলেই ল্যাঠা চুকে যায়; তখন তারাই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে লেনদেন চালিয়ে যাবে, তিনিও আর খেলাপি হবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক কৌশলে সেই কাজটিই করেছে। মন্দের ভালো এই যে, গভর্নর অফিসে বসে সার্কুলারটি জারি করেন। আগের জন তো হোটেলে গিয়ে এ জাতীয় কাজ করে দিয়ে এসেছিলেন।
বিগত অর্থবছরে মার্চ মাস পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। গত দুই বছর কভিডের কল্যাণে ছাড় পেয়ে বড় বড় ব্যবসায়ীরা ভালো গ্রাহক ছিলেন। এখন তাদের ভালো রাখতে এই ছাড়ের দ্বার উন্মুক্ত করা হচ্ছে। এখন যদি তারা নতুন করে ঋণ নিয়ে খেলাপি ঋণ পরিশোধও করেন, মুদ্রাস্ফীতি বাবদ বাট্টা কর্তন করা হলে তার নিট পরিমাণ অর্ধেকরও নিচে নেমে আসবে। অনেকে আবার সেটাও করছেন না; আবার তার জন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। এভাবে রাঘব-বোয়ালদের কইয়ের তেলে কই ভাজার এক অন্তহীন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে, আর ব্যাংকগুলো ভুগছে তারল্য সংকটে। পক্ষান্তরে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পের মালিকরা অর্থাভাবে অস্তিত্বের সংকটে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ এরাই অর্থনীতির প্রাণভোমরা; এরাই কর্মসংস্থানের প্রধান আধার। এরাই পারে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরতে।