কেমন হবেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী, ব্যতিক্রমী না প্রতীকী
বিজেপি কেন আলাদা, রাষ্ট্রপতি পদে সাঁওতাল দ্রৌপদী মুর্মুকে পছন্দ করা তার আরও একটা বড় প্রমাণ। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ যে আদিবাসী জনগোষ্ঠী, তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে এমন কোনো পদক্ষেপ এত দিন কেউ নেয়নি। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার ও বিজেপি এখানেই অন্য সবাইকে টেক্কা দিয়ে গেল। সিদ্ধান্তটি ঐতিহাসিক।
ওডিশাবাসী দ্রৌপদী মুর্মুর জয় নিয়ে বিজেপি সন্দিহান ছিল না। প্রতিযোগিতা ক্ষুরধার হলে হাজার ১৫ ‘ভোট মূল্যের’ যেটুকু ঘাটতি থাকত, শুধু ওডিশার বিজু জনতা দলের সমর্থনই তা মেটাতে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এ দেশে ‘পরিচয়ের রাজনীতি’ বহু আগল ভেঙে দেয়। পরিচয়ের রাজনীতির সামনে নীতি ও আদর্শ খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। কংগ্রেসের দোসর হয়েও ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা দ্রৌপদীকে সমর্থন করেছে। উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনাও তা-ই। রাজ্যে রাজ্যে ‘ক্রস ভোটিং’-এর বন্যা বয়েছে। নিট ফল, ঘাটতি মিটিয়ে ৬৪ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্রৌপদী জয়ী।
বিজেপি এখন এই জয় উদ্যাপনে বছরভর ব্যস্ত থাকার কর্মসূচি নিচ্ছে। এক লাখ গ্রামে তারা প্রচারে নামবে। হায়দরাবাদে দলীয় বৈঠকে নরেন্দ্র মোদি নিজেই প্রচারের ‘ব্লু প্রিন্ট’ বাতলেছেন। দ্রৌপদীর শপথ গ্রহণের দিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর লেখা এক নিবন্ধ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘স্বাধীনতাসংগ্রামে আদিবাসীদের অমূল্য ও অবিস্মরণীয় আত্মবলিদান সত্ত্বেও দুঃখজনক সত্য, স্বাধীনতা–পরবর্তী কোনো সরকারই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে তাঁদের জাতির মূল স্রোতে নিয়ে আসতে পারেনি। যথার্থ রাজনৈতিক পরিচয় সত্ত্বেও তাঁরা থেকে গেছেন বঞ্চিতের দলে।’ বিজেপির লক্ষ্য অতএব দুটি। প্রান্তবাসীর ক্ষমতায়ন এবং তাঁদের মূল স্রোতে টেনে আনা। ঘোষিত এই দুই লক্ষ্যের পাশে অঘোষিত চাহিদা, ভোটের রাজনীতিতে দ্রৌপদীকে ‘শোকেস’ করে ৯ শতাংশ অরণ্যবাসীর সমর্থন নিশ্চিত করা।
অনেক অঙ্ক কষে এ সিদ্ধান্ত। সারা দেশে চার সহস্রাধিক বিধানসভা আসনের মধ্যে তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত ৫৫৬টি, লোকসভায় ৫৪৩-এর মধ্যে সংরক্ষিত ৪৭টি। দ্রৌপদীর দৌলতে বিজেপি এ আসনগুলো কবজা করতে চাইছে। সমাজ ও রাজনীতিতে যা তাদের কাছে ’৮০ বনাম ২০’–এর (হিন্দু-মুসলমান) সংগ্রাম, হিন্দুত্ববাদীদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সেখানে তারা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর এ ৯ শতাংশ তালুবন্দী করতে চায়। আসাম ও ত্রিপুরার একাংশ বাদ দিলে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এ জনগোষ্ঠীই প্রধান। দ্রৌপদীতে ভর দিয়ে কংগ্রেস ও তার সহযোগীদের ‘বাড়া ভাতে ছাই’ ফেলে তারা মধ্যপ্রদেশে ৪৭, ওডিশায় ৩৩, ছত্তিশগড়ে ২৯, ঝাড়খন্ডে ২৮, গুজরাটে ২৭ এবং রাজস্থানের ২৫টি আদিবাসী সংরক্ষিত বিধানসভা আসন ছেঁকে তুলতে চায়। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি এ কারণেই আলাদা। দেড় দশক আগেও যে দলের পরিচিতি ছিল প্রধানত শহুরে, হিন্দিভাষী, বর্ণহিন্দু ও ব্যাপারীবেষ্টিত, আজ তা ‘প্যান ইন্ডিয়ান’ রাজনৈতিক শক্তি। দ্রৌপদীর আগমন ব্যাপ্তির সেই ব্যাসার্ধ আরও প্রসারিত করতে।