‘যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান’
রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি কাব্যের একটি কবিতার এই পঙ্ক্তি ঋণ করতে হলো আজকের নিবন্ধের শিরোনামে। কে না জানে, রবীন্দ্রনাথই আমাদের বড় মহাজন। দুঃখ-বেদনায় তাঁর কাছেই হাত পাততে হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগপর্যন্ত অনেক অপমানের শিকার হয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বাঙালির দ্বারাই। তবে ওই কবিতার উপজীব্য তাঁর নিজের অপমান নয়। হিন্দু সমাজে শতাব্দীর পর শতাব্দী নিম্নবর্ণ কীভাবে উচ্চবর্ণের কাছে নিগৃহীত হয়েছে, তার এক করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে এ কবিতায়, অনেকটা আর্তনাদের মতো। কবি উচ্চবর্ণকে সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, এমন নিগ্রহ যদি চলতে থাকে, ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। শুধু তা-ই নয়, পুরো সমাজই ভেঙে পড়তে পারে একসময়।
নিউটনের (গতির) তৃতীয় সূত্র বলছে: প্রতিটি কাজের (তথা বল প্রয়োগের) একটি সমমানের ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া হয়, যা জড়জগতের একটি ধ্রুব সত্য। ঠিক একই কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন কবিতার ভাষায়—
‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’
মনুষ্য জগতের এ এক অমোঘ সত্য।
বাংলাদেশে শিক্ষাগুরুদের নিগৃহীত হওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়, এর শিকার সংখ্যালঘু শিক্ষকেরাও। যেমন ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ এনে স্থানীয় মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে গ্রামবাসীকে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়। একপর্যায়ে জনসমক্ষে তাঁকে কান ধরে ওঠবস করান নারায়ণগঞ্জের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। কিন্তু সত্য জানা গেল শ্যামল কান্তি ভক্তের মুখ থেকে—তাঁকে স্কুল থেকে বিতাড়িত করতে দীর্ঘদিন ধরে ষড়যন্ত্র করছে স্কুল কমিটি। কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলামের বোন পারভীন আক্তারকে প্রধান শিক্ষক করতেই মূলত তাঁর বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র। কান ধরে ওঠবস করানোর একপর্যায়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান। এর আগে তাঁকে মারধরও হয়। এ কারণে তাঁকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালেও থাকতে হয়। অনুপস্থিতির অভিযোগে এবার তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগও করেন এই হতভাগ্য শিক্ষক। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তাতে কান ধরে ওঠবস করানোর নির্দেশদাতা সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই উত্থাপিত হয়নি। বাধ্য হয়ে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ জারি করেন। কিন্তু আসলে কি কোনো বিচার হয়েছিল? কারও কি শাস্তি হয়েছিল?
- ট্যাগ:
- মতামত
- শিক্ষক লাঞ্ছনা