বর্ম হিসেবে ধর্ম
সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রথাগত বিচারে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বেশ কিছু দিকই চিহ্নিত করা যায়। যেমন অবকাঠামোগত পরিবর্তন, পরিবহন ও যোগাযোগের সম্প্রসারণ এবং বহুতল ভবন বেড়েছে। রপ্তানি আয়ে গার্মেন্টস গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য; প্রবাসী আয় বৈদেশিক মুদ্রার বিশাল মজুত তৈরি করেছে। দেশজুড়ে শপিংমল তৈরি হচ্ছে; প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক তৎপরতায় ক্ষুদ্রঋণ ও এনজিও মডেল অনেক বিস্তৃত হয়েছে; নগরায়ণ, শহর-গ্রামে যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্প্রসারণে পেশাগত ও অর্থনৈতিক নতুন নতুন সুযোগ বেড়েছে। জনসংখ্যা যত বেড়েছে; খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। মানুষের সচলতা বেড়েছে। এ সবই সত্য। কিন্তু এসবের সুফলভোগী কারা? বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কি এর অংশীজন? উত্তরটা প্রীতিকর নয়।
এই সমৃদ্ধির গতি ও ধরনের কারণে প্রত্যক্ষ সুফলভোগী হয়েছে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী। এর সামাজিক ও পরিবেশগত খেসারতও অনেক বেশি। নদীনালা, খালবিল ও বন দখল এবং বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। বৈষম্য বেড়েছে। এই সময়েই দেশে একটি অতি-ধনিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছে। 'কালো টাকা' নামে পরিচিত চোরাই টাকার মালিকদের বিত্ত এবং দাপট বেড়েছে বহু গুণ। দেশ থেকে অর্থ পাচার রীতিমতো ভয়াবহ ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ঢাকা শহরে এখন একই সঙ্গে বিত্তের জৌলুস এবং দারিদ্র্যের নারকীয়তা দুটোই পাশাপাশি অবস্থান করে। চোরাই কোটিপতির সংখ্যা যখন বেড়েছে, তখন মাথাগণনায় দারিদ্র্যের প্রচলিত সংজ্ঞা বা কোনোভাবে টিকে থাকার আয়সীমার নিচে মানুষের সংখ্যা ৪ কোটির বেশি। যদি দারিদ্র্যসীমায় শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন যুক্ত করা হয় তাহলে দেখা যাবে শতকরা হিসেবে বড় একটি অংশের মানুষই অমানবিক জীবনে আটকে আছে।
নির্বিচার বেসরকারীকরণের জোর ধারায় সর্বজন বা পাবলিক সব প্রতিষ্ঠানই ক্ষত-বিক্ষত। এনজিও, কনসালটেন্সি ফার্ম, বেসরকারি ক্লিনিক ল্যাবরেটরি ও হাসপাতাল, বেসরকারি স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির বিস্তার ঘটেছে অনেক। দেশে প্রচুর সুপার মার্কেট ও গাড়ির দোকান গড়ে উঠেছে। কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, টিভি-ভিসিডিকেন্দ্রিক ব্যবসারও প্রসার ঘটেছে, যেগুলো প্রধানত আমদানিকৃত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। প্রচলিত উন্নয়ন ধারার কারণেই বাংলাদেশে আশির দশক থেকে শিল্প খাতের তুলনায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিকাশ ঘটেছে বেশি। স্বনিয়োগভিত্তিক কাজের অনুপাত বেড়েছে। এ ছাড়া রিকশা, অটোরিকশা, বাস, ট্রাক, টেম্পোসহ বিভিন্ন পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ছোট-বড় দোকান বেশিরভাগ মানুষের অস্থায়ী নিয়োজনের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'টুকটাক অর্থনীতি' হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমজীবী মানুষের প্রধান কর্মক্ষেত্র। এসব খাতে বেশিরভাগ কাজ অস্থায়ী ও অনিয়মিত; মজুরিও নিম্নমাত্রার।