বুদ্ধিজীবীরা কেন প্রলুব্ধ হন?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৭তম জন্মদিন সামনে রেখে বাংলাদেশের দুটি বহুল প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলো এবং দৈনিক সমকালের পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। সাক্ষাৎকার দুটি ২২ জুন প্রকাশিত হয়েছে। সমকাল তার সাক্ষাৎকারের শিরোনাম দিয়েছে 'বুদ্ধিজীবীরা এখন প্রলোভন ও ভয়ের শিকার'। প্রথম আলোতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের শিরোনাম হলো 'বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ভয় ও প্রলোভন দুটোই আছে'। সংবাদপত্র দুটি প্রায় একই ধরনের শিরোনাম দিয়েছে। পুরো সাক্ষাৎকারে বেশ কিছু বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। কিন্তু দুটি সংবাদপত্রের দৃষ্টিতে বুদ্ধিজীবীদের জন্য ভয় ও প্রলোভনের সমস্যা বক্তব্যের কেন্দ্রবিন্দুতে তুলে ধরা হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। দু'জন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিকের কাছে অধ্যাপক চৌধুরী ভয় ও প্রলোভনের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। দুটি পত্রিকা একই রকমের শিরোনাম করার ফলে আমার কাছে মনে হয়েছে, এই সময়ে বুদ্ধিজীবীদের দুর্বলতা আমাদের বিচলিত করে।
আমরা ভেবেছিলাম, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর বুদ্ধিজীবীদের কেউ আর কণ্ঠ রোধ করবে না। আমাদের সে আশা বিফলে গেছে। বিগত কয়েক বছরে সাংবাদিকরা অনেকেই ভোগান্তির কবলে পড়েছেন। অন্যদিকে, সমাজ থেকে সব ধরনের ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখতে ভয় ও ভীতির সঞ্চার করা হচ্ছে। এ রকম পরিবেশে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা খুবই কঠিন। তার পরও আমার কাছে মনে হয়েছে, ভয়ভীতির পরিবেশকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করলে শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট ভয়ভীতিকে জয় করা সম্ভব হতো।
পাকিস্তান আমলে সব বুদ্ধিজীবী একই দর্শনে বিশ্বাস করতেন না। তাঁদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিরাপদ করতে তাঁরা একই সঙ্গে মিলিত কণ্ঠে অনেক বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ মতামত প্রকাশ করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। বহু বুদ্ধিজীবী এই সময় নৃশংসভাবে খুনের শিকার হয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলের পরিস্থিতি আমার জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমি পর্যবেক্ষণ করেছি। মনে হচ্ছিল, পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী বুদ্ধিজীবীদের সহ্য করছে। দেখা গেল, আসলে বুদ্ধিজীবীদের সহ্য করা হতো না। তার প্রমাণ মিলেছে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডে। তখন মনে হয়েছে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে তাদের রাগ এবং ক্ষোভ জমা করছিল মাত্র। শাসকগোষ্ঠী তাদের হিংসার গরল ঢেলে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালে।
পাকিস্তান আমলে বুদ্ধিজীবীদের মাথা কিনে নেওয়ার প্রয়াস শুরু করেছিলেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা যাতে বিপজ্জনক হয়ে না ওঠেন, সে জন্য আইয়ুব খানের সময়ে রাইটার্স গিল্ড নামে একটি সংগঠন তৈরি করা হয়েছিল। এ সংগঠনের কাজ ছিল সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা এবং লেখক-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের লেখা প্রকাশের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া। সে সময় অনেক বুদ্ধিজীবী প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। আত্মসমর্পণের বিষয়টি খুবই সূক্ষ্ণ। মাও জেডং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় বলেছিলেন, তাঁর কমরেডদের মধ্যে অনেকেই চিনির আস্তরণ মাখা বুলেটের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, অথচ তাঁরা বিপ্লবের সময় রক্ত ঝরানো বুলেটের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। এ থেকে বোঝা যায়, একজন বুদ্ধিজীবী, যিনি গণমানুষের হয়ে কিছু বলতে চান অথবা লিখতে চান, তাঁর জন্য নানা রকমের বিপদ অপেক্ষা করে। রাষ্ট্র যতদিন আছে, ততদিন রাষ্ট্রের প্রতিবাদীদের নিজেদের পক্ষে টানার প্রয়োজন থাকবে। বুদ্ধিজীবীদের পোষ মানানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেওয়া হয়। এই প্রণোদনা হলো মাওয়ের চিনির আস্তরণ মাখা বুলেট। বুদ্ধিমান শাসকগোষ্ঠী দ্বিমত পোষণকারীকে কৌশল করে তার নিজের কাতারে কো-অপ্ট করে নেয়। কো-অপ্ট করার এই কৌশল আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ- রাজউকের প্লট, বিদেশ ভ্রমণ, বড় পদে নিয়োগ প্রভৃতি কো-অপ্ট করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বুদ্ধিজীবী