মূল্যস্ফীতির নেপথ্যে সুশাসনের অভাব
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ১৯ জুন প্রকাশিত হিসাবে মূল্যস্ম্ফীতি ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে। গত আট বছরের মধ্যে দেশে এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ম্ফীতির হার। দেশে মূল্যস্ম্ফীতির একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান, আমদানিজনিত চাপ ও বাজার কারসাজি উল্লেখযোগ্য। বাজার ব্যবস্থাপনায়ও দক্ষতা কম দেখা গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, চলমান মূল্যস্ম্ফীতির কারণে বাংলাদেশের স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো তাদের প্রকৃত আয়, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রয়োজনীয় খরচের ক্ষেত্রে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এর সঙ্গে কভিড-১৯ এর প্রভাব মিলে তাদের ক্ষতির বিষয়টি স্পষ্ট। এ দুয়ের ধাক্কা সামলে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানো অনেক পরিবারের জন্যই বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি তাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বিষয়টি নিয়ে আমরা গবেষণা করেছি এবং ৫ জুন গবেষণার তথ্য প্রকাশ ও হাজির করেছি।
'ইনফ্লেশন, কোপিং অ্যান্ড রিকভারি চ্যালেঞ্জেস' শিরোনামে আমাদের গবেষণায় শহরাঞ্চলের বস্তি ও গ্রামাঞ্চলের বড় জনগোষ্ঠীর ওপর একাধিক সমীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখার চেষ্টা করা হয়- কীভাবে দেশের স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট ব্যাপক ঝুঁকি তৈরি করছে। প্রায় ৪,০০০ পরিবারের ওপর করা জরিপে দেখা যায়, গত বছর দ্বিতীয় দফায় দেওয়া লকডাউন ও পরবর্তী রিকভারিতে মাথাপিছু দৈনিক আয় বেশ ভালোভাবে পুনরুদ্ধার হয়েছিল। গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত অনেকের আয় বৃদ্ধি পেলেও মূল্যস্ম্ফীতির কারণে জানুয়ারি এবং মে মাসের মধ্যে আয় আবার কমতে শুরু করেছে। ফলে মানুষ কভিড-পূর্বে যত আয় করত, বর্তমানে প্রকৃত আয় আশানুরূপ হচ্ছে না। কভিড-১৯ এর ধাক্কা সামলানোর সময়টিতে মূল্যস্ফীতি ঘটায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। মহামারির দু'বছর পর এখনও জরিপকৃত পরিবারগুলোর গড় আয় মহামারি-পূর্ব আয়ের ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ নিচে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মূল্যস্ফীতির প্রভাব বহুবিধ। এমনিতেই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পুষ্টি ও শিক্ষার যে লক্ষ্য নির্ধারিত, সেটি পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ কভিড-১৯ শহুরে বস্তিতে থাকা পরিবারগুলোর জীবন-জীবিকায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আবার গ্রামের তুলনায় শহরে আয়ের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অনেক ধীরে এগিয়েছে। আর এখন মূল্যস্ম্ফীতি সেই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে আরও মন্থর করেছে। গবেষণার তথ্য বলছে, দাম বেড়ে যাওয়ায় অন্তত জরিপে অংশ নেওয়া পরিবারগুলো ফেব্রুয়ারি মাস থেকে খাদ্যতালিকায় থাকা মূল খাবার যেমন- মাছ, মাংস, দুধ এবং ফল খাওয়া হয় খুব কমিয়ে দিয়েছে অথবা বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলের বস্তিতে খাবারের মান ও পরিমাণ দুটোই বেশ কমেছে। মে মাসে অর্থাভাবে প্রতি পাঁচ পরিবারে একটি পরিবার অন্তত এক বেলা খাদ্য গ্রহণ করেনি। আশঙ্কার কথা হলো, এই ব্যয় সংকোচনের ভেতর চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয়ের মতো খাতও ছিল। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে এসব পরিবার কম এমনকি নিম্ন মানসম্পন্ন পণ্য দিয়ে কাজ চালিয়েছে।