জনশুমারি কি ভূমিহীনদের কাছে যাবে
করোনা মহামারী যখন শুরু হলো তখন আমরা করোনা-উত্তর পৃথিবীর নানা সংকট নিয়ে আলাপ তুলেছিলাম। উৎপাদন, জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, মনস্তত্ত্ব, প্রযুক্তি, ক্ষমতা ও শ্রেণি কিংবা প্রতিদিনের দিনপঞ্জি হঠাৎ বদলে যাওয়া। কিন্তু আমরা প্রস্তুত ছিলাম না যে মহামারী-উত্তর পৃথিবীকে বেসামাল করবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কিংবা অস্থির বাজার। এমনি এক করোনা-উত্তর পৃথিবীকে বাংলাদেশ শোনাতে চাইছে দুই আশাজাগানিয়া গান। এ জুনেই বাংলাদেশে ঘটতে যাচ্ছে দুই স্মরণীয় ঘটনা। স্বপ্ন-ঘামের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি দেশের প্রথম ‘ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ সংগঠিত হবে ১৫-২১ জুন। নানাদিক থেকেই এই জনশুমারি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জনশুমারি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, দীর্ঘদিন চলেছিল ‘আদমশুমারি’। অনেক আগে থেকেই নিজের সব লেখায় জনশুমারি ব্যবহার করে এসেছি বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি আপ্লুত। বিশেষ ধন্যবাদ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে। নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার দায়িত্ব এই ডিজিটাল জনশুমারিকে সহযোগিতা করা এবং একে সফল করে তোলা। রাষ্ট্রীয় এই জনগুরুত্বপূর্ণ কাজটি সফল করে তোলার ক্ষেত্রে হয়তো সামাল দিতে হবে নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জ। চলতি আলাপখানি অতি নগণ্য এক সংকটের কথা তুলে ধরছে।
রাজশাহীর তানোরের পাঁচন্দর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে ২০২২ সালের ১৮ মে বুলডোজার দিয়ে একটি পাড়া নির্মমভাবে ভেঙেচুরে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার ভিডিও ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ঘরের টিন, বেড়া ভেঙেচুরে দেওয়া হচ্ছে। দুমড়েমুচড়ে উপড়ানো হচ্ছে গাছ। শিশু-নারী-পুরুষরা ছোটাছুটি করছেন। বুকভাসানো কান্না আর আতঙ্কে ঝিম হয়েছিল কৃষ্ণপুর। দেশসেরা সাংবাদিকদের অনেকেই রাজশাহী থাকেন। কিন্তু এ ঘটনায় কেন যেন নিশ্চুপ ছিল গণমাধ্যম, তাও আবার এমন এক মাসে যখন বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছে ‘বিশ্বমুক্ত গণমাধ্যম দিবস’। ঘর হারানো ভাসমান ত্রিশটি ভূমিহীন পরিবার কার্যত খোলা আকাশের তলে ছিলেন। দেশজুড়ে নিম্নবর্গের ভূমিহীনতার বিষয়টি জটিল এবং ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে প্রবলভাবেই জড়িত। চলতি আলাপ ঘর হারানো এই ভূমিহীন মানুষদের জন্য নতুন ঘর কিংবা খাসজমি বরাদ্দের দাবি জানাচ্ছে না। কিন্তু এই উদ্বাস্তু ভূমিহীনদের কীভাবে গুনবে দেশের প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি? রাষ্ট্রের প্রথম ডিজিটাল গৃহগণনায় ঘর হারানো এমন মানুষদের তথ্য কীভাবে নেবে সরকার? নিরন্ন, অসহায় এই গরিব মানুষরা স্থানীয় সরকার কী প্রশাসনের কাছে দৌড়ে গেছেন। কিন্তু কেউ এখনো তাদের একটু জায়গা বরাদ্দ দিতে পারেননি। যখন পদ্মা সেতুর গর্বে উৎসবে মাতবে দেশ, শুরু হবে দেশের প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি, তখন উদ্বাস্তু কিছু মানুষ আজন্ম দুঃখ নিয়ে সবকিছু থেকে পিছিয়ে থাকবে। আমরা কেউ এই পরিস্থিতি চাই না। দেশে কেউ পিছিয়ে বা আড়ালে থাকবে না, এই তো সরকারের উন্নয়নচিন্তা। তাহলে কারা, কেন, কীভাবে এই উন্নয়নচিন্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে? এর উত্তর রাজনৈতিকভাবে মানবিক মন নিয়ে আমাদের খোঁজা জরুরি। আমরা বিশ্বাস করি তানোর কী রাজশাহীর স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন চাইলেই কাজটি নিমিষে করতে পারেন। অন্তত ১৫ জুনের আগে ঘরহারা এই পরিবারগুলোর মাথার ওপর ছাউনি ও পায়ের তলায় মাটি নিশ্চিত করতে পারেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ভূমিহীন পরিবার
- ভূমিহীন
- জনশুমারি