বর্তমান বাজার পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য কতটা মঙ্গলজনক?
গত ৩ মে বাঙালির সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব রমজানের ঈদ উদযাপিত হয়েছে। অনুষ্ঠিত হয়েছে বেশ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ও আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে। শত হোক দুই বছর পর এই প্রথম মোটামুটি কভিড-১৯ মুক্ত পরিবেশে মানুষ নির্বিঘ্নে ঈদ উৎসব পালন করতে পেরেছে। এর আগে দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালন করেছি আমরা। নববর্ষ বরণ উৎসব এবং শ্রমিকদের ১ মে দিবস। এদিকে এটি বৈশাখ মাস, যা শেষ হবে ১৩ মে। সারা দেশে প্রধান ধানী ফসল কৃষকরা ঘরে তুলতে ব্যস্ত। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সরকার ধান সংগ্রহের বিশাল টার্গেট পরিপূরণের উদ্দেশ্যে কাজ করছে। সারা বৈশাখ মাস গেছে প্রচণ্ড গরম ও রোদের তাপে। প্রকৃতির খেলা পবিত্র ঈদের দিন আকাশ ছিল মেঘলা, অনেক জায়গায় পরিবেশ ছিল বৃষ্টিস্নাত। প্রধান ঈদের জামাত ছিল জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে, বায়তুল মোকাররমে, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় এবং দিনাজপুরের ঐতিহাসিক গোর-এ শহীদ ময়দানে। লাখো কোটি মুসল্লি যথাযথ ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের মধ্যে পবিত্র ঈদের নামাজ আদায় করেছে। এ উপলক্ষে লাখ লাখ লোক ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহর থেকে দেশের বাড়িতে নাড়ির টানে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পরিবহন খাতের সব মাধ্যমই ছিল ব্যস্ত, অতিরিক্ত ব্যস্ত। শত হোক দু-চারদিনের মধ্যে লাখ লাখ লোক ঢাকা ছেড়েছে, অন্যান্য শহর ছেড়েছে। আবার ঈদ শেষে মা-বাবার সঙ্গে দেখা শেষে যথারীতি তারা কর্মস্থলে আসতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রেও বিড়ম্বনা, বিশৃঙ্খলা, ভাড়া বৃদ্ধি ও কষ্ট। তবু সই। এটা বরাবরের চিত্র। অনেকটা মৌমাছির বিশৃঙ্খলার মতো। শত শত হাজার হাজার মৌমাছি মধু তৈরিতে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় চরম বিশৃঙ্খল থাকে। কিন্তু সময় শেষে ঠিকই মধু পাই আমরা। ঈদ উপলক্ষে গ্রামে যাওয়া-গ্রাম থেকে আসার চিত্র, তাতেও একই অবস্থা লক্ষণীয়। কিন্তু লাখো কোটি মানুষ এমন পরিবেশের মধ্যেই গ্রামে যায়, যথাসময়ে ঈদের নামাজ আদায় করে। মা-বাবার সঙ্গে সময় কাটায় আবার কর্মস্থলে ফিরে আসে। অথচ দৃশ্যত মনে হয় কী বিশৃঙ্খল অবস্থা চারদিকে। মানুষ মই দিয়ে ট্রেনের ছাদে ওঠে। বাসের ছাদে গাদাগাদি করে গন্তব্যে যায়। লঞ্চ-স্টিমার দেখলে মনে হয়, এই বুঝি তা ডুবে যাত্রী সব নিখোঁজ হলো। না, তা হয় না। এ অভিজ্ঞতা আমার কাছে দারুণ শিক্ষণীয় বিষয়। বিশৃঙ্খলার মধ্যে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন। দেখা যাচ্ছে মানুষ ঈদ উপলক্ষে শুধু বাড়ি যাচ্ছে না, তারা ছুটে গিয়েছে পর্যটন কেন্দ্রগুলোয়—কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, সিলেট, কুয়াকাটা—কোথাও তিল ধারণের স্থান নেই। ঢাকার আশপাশে আছে বহু আবাসিক রিসোর্ট, সেখানেও জায়গা নেই। লক্ষাধিক লোক এই অবস্থায়ও গেছে ভারতে। কোটির অধিক বাংলাদেশী ঈদ উদযাপন করেছে বিদেশে। অনেকে ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের সঙ্গে ঈদ করার জন্য গিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দুবাই, ইউরোপীয় দেশ এবং কানাডা ও আমেরিকা। যেহেতু ছুটির দিন ছিল বেশি, তাই মানুষ পাগলের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে—দুই বছরের ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য। কাগজে দেখলাম একমাত্র কক্সবাজারেই এই কয়েক দিনের মধ্যে পাঁচ লাখ পর্যটক বেড়াতে গেছে। হোটেল-রিসোর্ট মালিকরা বলছেন, এতে তাদের ব্যবসা হবে ৫০০ কোটি টাকার। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, সিলেট, কুয়াকাটা ও খুলনা হিসাবে নিলে কত টাকার আবাসিক হোটেল ব্যবসা হতে পারে তা অনুমান করা কঠিন। শুধু পর্যটন ব্যবসা নয়, ঈদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ব্যবসা। জামা-কাপড়, জুতা-মোজা, খাদ্যদ্রব্য, বৈদ্যুতিক সাজ-সরঞ্জামাদি থেকে শুরু করে ব্যবসা হয়েছে পরিবহনের। এ ব্যবসার পরিমাণ কত? এর আনুমানই শুধু করা যেতে পারে, প্রকৃত ব্যবসার পরিমাণ বলা খুবই কঠিন।
সরকারি কোনো তথ্য নেই। তবে কয়েকটা সূচক ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন ঈদের আগে ব্যাংক খালি করে লোকে টাকা তুলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হাজার হাজার কোটি টাকা বাজারে ছেড়েছে। নতুন নোটই প্রচলন করেছে ২৩ হাজার কোটি টাকার। ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের অধিকাংশই বেতন-ভাতা পেয়েছেন। ৩০-৪০ লাখ সরকারি-বেসরকারি খাতের কর্মকর্তা ও কর্মচারী যথারীতি বেতন-ভাতা পেয়েছেন এবং তা নিয়ে বাজারে নেমেছেন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীরা ২০০ কোটি ডলার এপ্রিলে পাঠিয়েছেন। এর সুবিধাভোগী কোটিখানেক পরিবার। ধনী ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা গরিবদের অর্থ সাহায্য দিয়েছেন। জাকাতের টাকা এসেছে বাজারে। আছে মৌসুমি বোরো ধান বিক্রির জমানো টাকা। এমনকি ধার-কর্জের টাকাও ঈদ উপলক্ষে ব্যয় হয়। রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলের হাজার হাজার রিকশাওয়ালা, বুয়া শ্রেণীর লোক আছে, যারা ঈদের সময় তাদের জমানো টাকা নিয়ে দেশে যায় বাসভর্তি, ট্রেনভর্তি হয়ে। রয়েছে বকশিশের টাকা। সব মিলিয়ে লাখ লাখ লোক বিশাল পরিমাণের ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে ঈদের বাজার করেছেন। গিয়েছে পর্যটন কেন্দ্রগুলোয়। বিনোদনের জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর এবং মফস্বলের অঞ্চলগুলোয় হাজির হয়েছে লাখ লাখ লোক। চারদিনে কেবল চিড়িয়াখানাতেই গিয়েছে সাড়ে তিন লাখ লোক। তাদের হাতেও খরচের টাকা ছিল। এভাবে দেখলে বোঝা যায় বিলিয়ন বিলিয়ন (এক বিলিয়ন সমান শত কোটি) টাকা খরচ হয়েছে ঈদ উপলক্ষে। ফলে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামে গিয়েছে প্রচুর ‘ক্যাশ’। গ্রামের বাজার পুনরুজ্জীবন পেয়েছে দুই বছর পর। বলা যায় এবার ব্যবসায়ী, ভোগ্যপণ্য বিক্রেতা, কাঁচামাল বিক্রেতা, হোটেল-মোটেলওয়ালা, রেস্টুরেন্টওয়ালা, পরিবহন মালিকরা দুই বছরের লোকসান অনেকটা পুষিয়ে নিয়েছেন। তবে শুনেছি বাস-ট্রাকওয়ালারা এবার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি ছিলেন মোটরবাইকের সঙ্গে। ইজিবাইক, টেম্পো ইত্যাদি পরিবহন মাধ্যম এখন বেশ জনপ্রিয় এবং তাদের ব্যবসা জমজমাট। তরুণ ও যুবকরা এর সঙ্গে জড়িত।
- ট্যাগ:
- মতামত
- পরিবহন
- ধর্মীয় উৎসব
- অর্থনীতি