বাজেট বিবেচনার কয়েকটি বিষয়
সংসদীয় গণতন্ত্রে বাজেট প্রণয়ন, পর্যালোচনা ও পাসের এখতিয়ার সংসদের। মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে বাজেট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপিত হয় এবং সংসদে পরীক্ষা-পর্যালোচনার পর সংসদের বাজেট পাম প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতির সম্মতি (ধংংবহঃ) গ্রহণের বিধান আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সুতরাং সংসদের পূর্ণ দায়িত্ব কর আরোপের এবং পাবলিক মানি বরাদ্দ ও ব্যয়ের অনুমোদন তত্ত্বাবধানের। অর্থ বিলে যে পরিমাণ অর্থ অনুমোদিত থাকবে তার মধ্য থেকে আয়-ব্যয় নির্বাহের জন্য নির্বাহী বিভাগ ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এর বাইরে যে কোনো প্রকার আয়-ব্যয় ও নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন আলাদাভাবে সংসদের সম্মতি এবং অনুমোদনে হতে হবে। বাজেট যেহেতু নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনার পথনকশা এবং জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতার দলিল সেহেতু সংসদে উত্থাপিত বাজেট প্রস্তাব চুলচেরা বিশ্লেষণ ও অনুমোদন সুপারিশে সংসদে বাজেট বিতর্কের তাৎপর্য ও ভূমিকা অপরিসীম।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষভাগে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপনা পর্ষদে (শেরে বাংলা একে ফজলুল হক প্রমুখের বাজেট বিতর্ক) এবং এমনকি তদানীন্তন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাজেট নিয়ে যে আলোচনা হতো তা পাঠ-পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একটি ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোতেও আইন পরিষদে বাজেটে অর্থনীতির নীতি-কৌশল নিয়ে প্রাণবন্ত অথচ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হতো। তাতে তথ্য উপাত্তের সঙ্গে যুক্তিতর্কের সুমহান এমন সম্মিলন ঘটত। পাকিস্তান শাসনামলে বিশেষ করে, ৬ দফা আন্দোলন চলাকালীনও বাজেটে দেশের উভয় অংশের উন্নয়ন কৌশলে বৈষম্য ও বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে যা উত্থাপিত হতো সেগুলো সংসদের বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও রাজনীতি বিভাগের প্রাজ্ঞ প-িতপ্রবরদের বাজেট বিশ্লেষণ স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নেতৃবৃন্দ এবং আইন পরিষদ তথা দায়িত্বশীলদের দৃষ্টিসীমায় পৌঁছাত। সে সময়কার বাজেট বিতর্ক বিনির্মাণে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং প্রাজ্ঞ আলোচনার সুযোগের সদ্ব্যবহার চলত। সংসদে আর্থিক নীতি ও কৌশল নিয়ে বাজেট বিতর্ক বিশ্বের বহুদেশে রাজনৈতিক অর্থনীতির মাইলফলক হিসেবে দেখা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশেও সেই প্রথম থেকে বাজেট প্রণয়ন ও নীতি বিশ্লেষণের ধারায় অনেক নতুন প্রবণতা, প্রাকরণিক প্রৎকর্ষতা বিশেষ করে বাজেটের প্রতি গণআগ্রহ ও অবহিতির ব্যবস্থা ছিল। এটাও ঠিক মিডিয়ার ভূমিকায় বাজেট প্রণয়ন ও বিশ্লেষণে অনেক সংস্কার সাধিত হয়েছে। মিডিয়া, চিন্তা চৌবাচ্চা সিপিডিসহ সুশীল সমাজ বাজেট বিশ্লেষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এ প্রেক্ষাপটে আসন্ন ২০২২-২৩ জাতীয় বাজেটের ওপর সংসদে কিংবা সংসদের তর্কবিতর্কের হালহকিকত অনুধ্যান অধ্যয়নে গেলে দেখা যায় বাজেটের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাসহ উন্নয়ন দর্শন ও নীতি-কৌশল নিয়ে বিতর্কের (যা করোনা বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও কিয়েভ-ক্রেমলিন সমর সংক্ষুব্ধ অর্থনীতি সামাল দেওয়ার জন্য, ভবিষ্যৎ পথনকশা নির্ণয়-নির্ধারণের জন্য জরুরি) চেয়ে অতি তাৎক্ষণিক বিষয় (আগামী নির্বাচনের প্রাক্কালে তাৎক্ষণিক ব্যয় বরাদ্দ , করহার কমানো ইত্যাদি) ও তাদের সাময়িক প্রভাব নিয়ে সংসদের বাইরে কমবেশি আলোচনায় ক্লান্ত শ্রান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সে আলোচনার ভিড়ে বাজেটে প্রক্ষেপিত অর্থনীতিতে অর্জিত সম্পদ ব্যবস্থাপনার নীতি-কৌশল, উন্নয়ন অভীপ্সার অভিসার, দেশকে সম্ভাব্য সমস্যা থেকে রক্ষা করে স্বয়ম্ভরতার পথে নিয়ে যাওয়ার পথনকশায় গতি-প্রকৃতি শনাক্তকরণ ও সমালোচনার সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে। যে বিষয়গুলো আড়ালে আবডালে থেকে যাচ্ছে তার মধ্যে মাত্র কয়েকটি নিম্নরূপ
জাতীয় বাজেটের জাতীয়তা বা গণতান্ত্রিক চরিত্র বিকাশের পরিবর্তে দুর্বল হচ্ছে : আমজনতার বাজেট বস্তুত জনগণের জন্য এবং জনগণের দ্বারা প্রণীত ও বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। যাদের বাজেট তাদের মতামত সেখানে প্রতিফলিত হওয়া বাঞ্ছনীয় এ জন্য যে তাহলে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন উন্নয়ন কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন এবং সম্পদের সুষম বণ্টন সম্ভব হয়। বাজেট বাস্তবায়নের দ্বারা সুফল প্রাপ্তিতে পক্ষপাতিত্ব, একদেশদর্শিতা, বৈষম্য ও বঞ্চনা বৃদ্ধি কিংবা কর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিপক্ষতার পরিবেশ সৃষ্টি সমন্বিত উন্নয়ন সাধন ধারণার পরিপন্থী। নির্বাহী বিভাগ (অর্থ মন্ত্রণালয়) তাদের বশংবদ অভ্যাসবশত, সবার সঙ্গে আলোচনা সুপারিশ পরামর্শকে প্রতিফলন থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে যে নীতি- দৃষ্টিকোণ অবস্থা ব্যবস্থা বাজেটে প্রস্তাব করেন, জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী আইন পরিষদের তাতে যদি তেমন কিছু বলার বা করার না থাকে তাহলে তো বাজেটের জাতীয় চরিত্র মেলে না। বাজেট বাস্তবায়নকালের পরিস্থিতি পরিবেশ, গতি-অধোগতি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনার রেওয়াজ গড়ে উঠছে না বলেই বাজেটের গণতান্ত্রিক গুরুত্ব বিকশিত হচ্ছে না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জাতীয় বাজেট