বৈষম্য বাড়ছে, বিচ্ছিন্নতাও
সামাজিক জীবনে আমরা ক্রমাগত পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। সামাজিক জীবনাচার প্রায় লুপ্ত হওয়ার পথে। সমাজজীবনের সব স্তরে অতীতের সামাজিকতা-সামাজিক সংহতি এখন আর তেমন অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। তার প্রভাব আমাদের পারিবারিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত ভর করেছে। এই বিচ্ছিন্নতা বিদ্যমান ব্যবস্থারই সৃষ্টি। ব্যবস্থাটিই আমাদের প্রত্যেককে প্রত্যেকের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। সামষ্টিক ধ্যানধারণা, চিন্তা-ভাবনাগুলো একে একে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। একই সমাজে বসবাস করলেও কেউ যেন কারও নয়। পরিবারগুলোর ক্ষেত্রেও অভিন্ন অবস্থা বিরাজমান। অথচ একসময় আমাদের প্রায় প্রতিটি পরিবার একান্নবর্তী ছিল।
কালের বিবর্তনে যৌথ পরিবারের অস্তিত্ব এখন খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। এখন পরিবার বলতে ব্যক্তি এবং তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদেরই আমরা বুঝে থাকি। এর বাইরে পরিবারভুক্ত কাউকে বিবেচনা পর্যন্ত করি না। নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পরও একান্নবর্তী পরিবারমাত্রই আদর্শ পরিবাররূপে বিবেচিত হতো। যৌথ পরিবারে যৌথ বা সামষ্টিক ভাবনা ও সংস্কৃতি ছিল অনিবার্য। একক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবনার সুযোগ ছিল না। ব্যক্তিগত ভাবনার বিপরীতে সমষ্টিগত ভাবনা একান্নবর্তী পরিবারের অপরিহার্য সংস্কৃতিরূপে বিরাজিত ছিল। প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের সক্রিয় ছিল দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। ছিল সামষ্টিক তাড়নাও। ব্যক্তিগত বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানসিকতার পরিবর্তে সমষ্টিগত ভাবনার প্রাসঙ্গিকতায় বিচ্ছিন্নতার অবকাশ ছিল না। একান্নবর্তী পরিবার থেকে পৃথক হওয়াকে সামাজিকভাবে অপরাধরূপে গণ্য করা হতো। সামাজিক ভীতির কারণেই নানা সমস্যা, দ্বন্দ্ব-বিবাদেও যৌথ পরিবার ত্যাগের সাহস সহজে কেউ করত না। সেই একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। সামাজিক সম্পর্ক এবং সামাজিকতাগুলো এখন লুপ্তপ্রায়। বিচ্ছিন্নতা যেমন গ্রাস করে ফেলেছে সমাজ-জীবনকে, একইভাবে পরিবারগুলোকেও।
ব্যক্তিগত বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রভাবে সমাজ-জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা সর্বাধিক দৃশ্যমান। এই বিচ্ছিন্নতার মূলে অবশ্যই বিদ্যমান ব্যবস্থাকে দায়ী করা যায়। ব্যবস্থার পরিবর্তনেই কেবল বিচ্ছিন্নতার অবসান সম্ভব। নয়তো বিচ্ছিন্নতা আরও প্রকট ও ভয়াবহরূপে আমরা অধিক মাত্রায় প্রত্যক্ষ করব। আমাদের ধারাবাহিক সমাজকাঠামোর সব আন্তসম্পর্ক ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। নীরব ঘাতকের মতো নিঃশব্দে পুঁজিবাদের বিস্তৃতি ও প্রসার ঘটেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুঁজিবাদ তার আগ্রাসী অপতৎপরতা নিশ্চিত করে ফেলেছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার সর্বনাশী অপতৎপরতা সমাজে ভয়ানক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে; যা অনিবার্যরূপে পুঁজিবাদেরই সৃষ্টি। সজাগ ও সচেতন না হলে পরিণতি আরও ভয়াবহ যে হবে, সে বিষয়ে তো সন্দেহের অবকাশ নেই।
ব্যক্তিগত উন্নতির প্রতিযোগিতা সর্বত্র প্রকট আকার ধারণ করেছে। সমষ্টির উন্নতির কথা কেউ ভাবছে বলে ধারণাও করা যাবে না। ব্যক্তির উন্নতি সমষ্টিকে কখনো স্পর্শ করতে পারে না; বরং সমষ্টিকে ডিঙিয়ে-পেছনে ঠেলেই ব্যক্তির উন্নতি ঘটে। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা সমাজ ও পরিবারে বিচ্ছিন্নতাকেই নিশ্চিত করেছে। আমাদের শ্রেণিবিভক্ত সমাজে আর্থিক মানদণ্ডেই পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি এবং অবনতি নির্ভর করে। একই পরিবারের একজনের উন্নতি পরিবারের অন্যদের সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করে। শ্রেণিবৈষম্যে যোজন-যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়। অর্থনৈতিকভাবে সমানে-সমান না হলে বিচ্ছিন্নতার অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে যায়। নিকটাত্মীয় অনাত্মীয় এবং অনাত্মীয় নিকটাত্মীয় হওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মানদণ্ড তথা শ্রেণিগত অবস্থানের ওপরই নির্ভর করে। শ্রেণি সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক, আত্মীয়তা নির্ভর। অসম শ্রেণিগত অবস্থানে নিকটাত্মীয় আর আত্মীয় থাকে না। অনাত্মীয় হয়ে যায়। পুঁজিবাদের ঘাতক ব্যাধিতে সমাজ-পরিবারে সম্প্রীতির অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। যার দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত সমাজজীবনের বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতা সব সামাজিক-পারিবারিক সম্পর্ককে গ্রাস করে চলেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বৈষম্য
- বিচ্ছিন্নতা
- ব্যক্তিগত জীবন