রিজার্ভ: খরচে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে
আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় ও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। এই অবস্থায় রিজার্ভ বেশি থাকলে, ব্যাংকে তারল্য প্রবাহ পর্যাপ্ত হলে, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ ও ঋণপ্রবাহ চলমান থাকলে ঝুঁকি মোকাবিলা সহজ হতো। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স-প্রবাহ কম থাকায় তা দিয়ে আমদানিসহ অন্যান্য ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকায় দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও কমছে। এদিকে আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়া এবং রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক সম্পদের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এ পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যয় কমিয়ে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণে জোর দেওয়ার পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে দেশের দরিদ্রপ্রবণ এলাকাগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় এখন তারা সারা বিশ্বে আলোচনার তুঙ্গে। অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দেশটিতে খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির মতো বিপর্যয়ে বাংলাদেশও পড়তে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখনই সতর্ক হলে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি নাও হতে পারে। বাংলাদেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা খুবই ভালো। তাই অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা খুব ভালো। যেটা শ্রীলঙ্কার ছিল না। এজন্যই অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশটি। এছাড়া জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাত সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। তাই শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বাড়ার পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা দিয়ে আমরা ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারব। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার তা ২ বিলিয়ন ডলারেরও কম। যা দিকে এক সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানোও সম্ভব নয়। তাই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা চলে না। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট বিষয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত সতর্ক। বাংলাদেশকে প্রতি বছর ঋণ বাবদ পরিশোধ করতে হয় ২ বিলিয়ন ডলার। আর শ্রীলঙ্কাকে করতে হয় ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ হলো তার জিডিপির ৬১ শতাংশ। আর বাংলাদেশের তা ১৩ শতাংশ। এছাড়া দেশটির মোট ঋণ (ঋণ জিডিপি অনুপাত) ১২০ শতাংশের কাছাকাছি, বাংলাদেশের তা ৪৫ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বেশির ভাগ বৈদেশিক ঋণ কঠিন শর্তে নেওয়া। পক্ষান্তরে সহজ শর্তে এসব ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উত্স হলো পর্যটন খাত। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর এই খাতে ব্যাপক ধস নামে, যার আঘাত লাগে সরাসরি রাজস্ব আয়ে। অন্যদিকে, বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ঠিকই পরিশোধ করতে হয় দেশটিকে। শ্রীলঙ্কায় পর্যটক বাড়াতেই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। এর পাশাপাশি শিল্প উত্পাদনে ধস এবং রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স-প্রবাহও নিচের দিকে নেমে যায়। তার ওপর কর ও ভ্যাট কমায় দেশটির বর্তমান সরকার। এছাড়াও চাষাবাদে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাদ দিয়ে অর্গানিক খাদ্য উত্পাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে সেখানে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। এমনকি এর প্রভাবে দেশটিতে চায়ের উত্পাদনও কমে যায়। এসব কারণে শ্রীলঙ্কায় এই অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের নেওয়া বেশির ভাগ মেগা প্রকল্পগুলো মূলত যোগাযোগ ও জ্বালানি উত্পাদনের জন্য। এর মধ্যে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পরমাণু বিদু্যত্কেন্দ্র, রামপাল কয়লা বিদু্যত্কেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লা বিদু্যত্কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও গভীর সমুদ্রবন্দর অন্যতম। এর মধ্যে পদ্মা সেতু ছাড়া বাকি সব প্রকল্প বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের ঋণের হার জিডিপির ৩৮ শতাংশ। গত বছরের জুন পর্যন্ত মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণের এই হার জিডিপির ১৩ শতাংশ। আইএমএফর মতে, বৈদেশিক ঋণের হার ৫৫ শতাংশের বেশি হলেই তা যে কোনো দেশের জন্য সংকট তৈরি করতে পারে। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। এর বিপরীতে ঋণ পরিশোধ করতে হবে ৪ বিলিয়ন ডলার। তার ওপর খাদ্য ও বিদু্যত্সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ শ্রীলঙ্কার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার মতো অর্থ নেই।