হাফ বাবু ফুল বাবু বাঙালি
১৪২৯-এর বৈশাখের ৭ তারিখে দেশ রূপান্তর পত্রিকায় কেবল পদ্যের উদ্ধৃতি টেনে বাঙালি বন্দনা করে বাঙালিদের জন্য যথেষ্ট করেছি বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু অচিরেই বোধ হলো এতে বঙ্গীয় গদ্যকারদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে, বাঙালি সংকীর্তনে তাদের অবদানও কম নয়, তাদের রচনা উপেক্ষা করা সমীচীন হবে না। সুতরাং গদ্য কিস্তির একটি সংকলন করতে হলো। ১২৭০ বঙ্গাব্দে শীল অ্যান্ড ব্রাদার্সের মুদ্রণযন্ত্রে প্যারিমোহন সেন (১৮১৪-১৮৪৮)-এর লেখা ‘রাঁড়, ভাঁড়, মিথ্যা কথা, তিন লয়ে কলিকাতা’ ছাপা হলো। এটি গীতিনাটক। শুরুতেই নিপাট গদ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হিতোপদেশ, যা বাঙালি বাবুদের অবশ্যমান্য : পর স্ত্রী পর ধন, সদা করিবে হরণ। (প্যারিমোহন সেন আশ্বস্ত থাকতে পারেন তার স্বজাতি এই হিতোপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।) মিথ্যা কথা, প্রতারণার আশ্রয় নাও। (প্যারি বাবু, সে কী আর বলতে। ওটা তাদের রক্তের মধ্যেই আছে, হিতোপদেশ দিয়েছেন বেশ, একটুও ভাববেন না, আপনার জাতি ষোলো আনা বাস্তবায়ন করে চলেছেন।) মিছে কাল কর গত, মদ্যপানে হও রত। (মন্দ বলেননি গুরু, বোতলের দামটা একটু বেশি এই যা।) সুখ পাবে বিধিমতো, বেশ্যাসক্ত হও। (প্যারিমোহন সেন এসব বলে লজ্জা দিচ্ছেন বাবু!) হাস খেল অনিবার, ত্যাজ পুত্র পরিবার। (সে কী আর বলতে!)
বাবু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও (১৮৩৮-১৮৯৪) বাঙালি বাবুদের ভালোই চিনেছিলেন : ‘যাঁহার যতœ কেবল পরিচ্ছদে, তৎপরতা কেবল উমেদারিতে, ভক্তি কেবল গৃহিণী কিংবা উপগৃহিণীতে এবং রাগ কেবল সদগ্রন্থের উপর, নিঃসন্দেহে তিনিই বাবু।’
বাঙালি বাবুদের সম্পর্কে বুঝেশুনেই তিনি আরও লিখেছেন :
‘যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তকমধ্যে, যৌবনে বোতলমধ্যে, বার্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে, তিনিই বাবু।’ ‘যাঁহার ইস্ট দেবতা ইংরাজ, গুরু ব্রাহ্মধর্ম্মবেত্তা, বেদ দেশী সম্বাদপত্র এবং তীর্থ ন্যাশনাল থিয়েটার, তিনিই বাবু।’
‘যিনি মিশনারির নিকট খ্রীষ্টিয়ান, কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রাহ্ম, পিতার নিকট হিন্দু এবং ভিক্ষুকব্রাহ্মণের নিকট নাস্তিক, তিনিই বাবু।’ ‘যিনি নিজ গৃহে জল খান, বন্ধু গৃহে মদ খান, বেশ্যা গৃহে গালি খান এবং মুনিব সাহেবের গৃহে গলাধাক্কা খান, তিনিই বাবু।’ ‘যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথোপকথনকালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা, তিনিই বাবু।’
হুতোম প্যাঁচার নকশায় কালীপ্রসন্ন সিংহের (১৮৪১-১৮৭০) দেওয়া বাবু পরিচিতি : ‘বনেদী বড় মানুষ হতে গেলে বাঙালী সমাজে যে সব ভাষাগুলি আবশ্যক, আমাদের বাবুদের তা সমস্তই সংগ্রহ করা হয়েছে। বাবুদের নিজেদের একটি দল আছে, কতকগুলি ব্রাহ্মণপন্ডিত, কুলীনের ছেলে বংশজ ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, বৈদ্য, তেলী, গন্ধবেসে, কাঁসারী ও ঢাকাই কামার নিতান্ত অনুগত বাড়ীতে ক্রিয়াকর্ম্ম ফাঁক যায় না, বাৎসরিক কর্র্ম্মেও দলস্থ ব্রাহ্মণদের বিলক্ষণ প্রাপ্তি আছে। আর ভদ্রাসনে এক বিগ্রহ, শালগ্রামশিলে ও আকবরী মোহর পোরা লক্ষ্মীর খুঁচির নিত্যসেবা হয়ে থাকে।’