লঙ্কায় অগ্ন্যুৎপাত
দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কা এখন রীতিমতো জ্বলছে। এ আগুন পৌরাণিক কাহিনীর হনুমান লাগায়নি, হাল আমলের টাইগার যোদ্ধাও এ কাজ করেনি। এটা করছে সিংহলের সাধারণ জনসাধারণ। কারণ, দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও তারা রান্নাবান্নার জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস পাচ্ছে না, দিনরাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না, খাদ্যদ্রব্যের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে পড়েছে। জ্বালানির অভাবে অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কাগজের অভাবে ছাত্রদের পরীক্ষা পর্যন্ত বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি কলম্বো স্টক একচেঞ্জও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি চলছে অশ্বকদম্ব গতিতে; এখন এক ডলার কিনতে ৩০০ শ্রীলঙ্কান রুপির বেশি প্রয়োজন হচ্ছে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস; তারা অনন্যোপায় হয়ে ক্ষমতাধর নির্বাহী প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করছে, কেউ কেউ তার বাসভবনে ঢিল-পাটকেল নিক্ষেপ করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘোষণা করতে হয়েছিল জরুরি অবস্থা; জারি করতে হয়েছিল কারফিউ। কিন্তু কেউ সেটা মানেনি।
ভারত মহাসাগরের মুক্তা হিসেবে খ্যাত প্রায় শতভাগ শিক্ষার হার সম্পন্ন এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নে ছিল উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অগ্রসর দেশটির মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ৪০০০ ডলারেরও বেশি। কিন্তু ২০১৯ সালে তার অবনমন ঘটে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে। বিগত জানুয়ারিতে S & P (Standard and Poor)) এর মূল্যায়নে দেশটির ঋণ মান নেমে দাঁড়িয়েছে সিসিসি নেগেটিভ। এর অর্থ হলো দেশটিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ; ফলে সার্বভৌম নিশ্চয়তায়ও কেউ যদি ঋণ নিয়ে এগিয়ে আসে, তার জন্য সুদ হার হবে আক্রা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।
সাধারণত কোনো বড় বিপর্যয় একটি মাত্র কারণে সংঘটিত হয় না; এর জন্য প্রয়োজন হয় অনেক অনুঘটকের পারস্পরিক পরম্পরা। শ্রীলঙ্কায়ও তাই হয়েছে; নীতিনির্ধারকদের আর্থিক অব্যবস্থাপনা যেমন এর জন্য দায়ী, তেমনি প্রাকৃতিক বা নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত বিপর্যয়ও এ অবস্থার জন্য কম দায়ী নয়। এখন বলা হচ্ছে যে, ২০০৯ সালে তামিলদের সঙ্গে চলমান গৃহযুদ্ধের ইতি ঘটার পর দেশটি ভারতীয় প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে প্রয়াসী হয়। কিন্তু ঐ বছরই সংঘটিত ইস্টার সানডে হত্যাকা-ে কয়েকটি গির্জা ও বিলাসবহুল হোটেলে ২৬৯ জন মানুষ জীবন হারায়। ফলে জিডিপিতে ১০ শতাংশ অবদানক্ষম পর্যটন নিষ্ফলা হয়ে পড়ে ও বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা শুরু হয়ে যায়। এ সময় চীন ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় বিআরআই (Road and Belt Initiative এর আওতায় শ্রীলঙ্কার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। দেশে গ্রহণ করা শুরু হয় একের পর এক মেগা প্রকল্প যার অনেকগুলো চটকদার ও জনপ্রিয় হলেও লাভজনক ছিল না; এর মধ্যে রাজাপাকসের নির্বাচনী এলাকার হাম্বানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর, রাজাপাকসে বিমানবন্দর ও সমুদ্রের তলদেশ থেকে উদ্ধারকৃত ২.৬ বর্গ কিলোমিটার ভূমি সংবলিত কলম্বো পোর্ট সিটি নির্মাণ অন্যতম। হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর আর্থিক দিক থেকে লাভজনক না হওয়ায় শ্রীলঙ্কান সরকার সেটিকে এখন চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিয়ে দিয়েছে। রাজাপাকসে বিমানবন্দর এখন পৃথিবীতে অন্যতম অলস বন্দর হিসেবে চিহ্নিত। কলম্বো পোর্ট সিটি এখনো নির্মাণাধীন। কিন্তু এটার অবস্থা ভিন্নতর হবে বলে কেউ মনে করে না। এটাকেই পশ্চিমা বিশ্ব চীনা ঋণের ফাঁদ বলে চিহ্নিত করে, যদিও চীনা ঋণের পরিমাণ দেশটির মোট ঋণের ১০ শতাংশের বেশি না।
আসলে বৈদেশিক ঋণ শ্রীলঙ্কার জন্য নতুন কিছু না। দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ অনেক। বর্তমানে দেশটির ঋণ-জিডিপির হার ১১৯ শতাংশ। তবে ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালে আসার পর বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দিগুণেরও বেশি হয়ে যায়। এখন মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। সমস্যা হলো ২০২২ সালের জুনের মধ্যে দেশটিকে বৈদেশিক ঋণ-সেবায় (আসল ও সুদ) ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু তার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আছে মাত্র ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ ২০১৮ সালেও রিজার্ভ ছিল প্রায় ৭ বিলিয়ন। প্রেসিডেন্টের ভাষ্য বর্তমান সমস্যার মূলে রয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অর্থনৈতিক সংকট