সমস্যা টিপে নয়, মোরাল পুলিশিংয়ে
রাজধানীতে পুলিশের পোশাক পরিহিত এক পুরুষ টিপ পরিহিত এক নারীকে উত্যক্ত করেছেন, কটূক্তি করেছেন, শারীরিক আক্রমণও করেছেন। এ ঘটনায় ওই নারী আইনি প্রতিবিধান চেয়েছেন রাষ্ট্রের কাছে। থানায় অভিযোগ করেছেন। আইনি সহায়তা চাওয়া ওই নারীর এই প্রতিবাদ ছড়িয়েছে সামাজিক মাধ্যমে, গণমাধ্যমে, এমনকি সংসদেও। সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা সংসদে দাঁড়িয়ে ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন, আইনি প্রতিবিধান চেয়েছেন, কোন আইনে টিপ পরা যাবে না এমনটা জানতে চেয়েছেন। সুবর্ণা মুস্তাফার এই প্রশ্ন সংসদে রেকর্ড হয়ে আছে শুধু এখন পর্যন্ত, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। বলতে বাধ্য হই— হয়তো তাকে খুঁজছে না পুলিশ। তা না হলে রাজধানীর ব্যস্ততম একটা এলাকায় এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার পর কীভাবে ওই লোকটি এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অচিহ্নিত থাকে?
যে নারীকে পুলিশের এই উত্যক্ত তিনি একজন শিক্ষক। তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার। তার অভিযোগ—‘আমি হেঁটে কলেজের দিকে যাচ্ছিলাম, হুট করে পাশ থেকে মধ্যবয়সী, লম্বা দাঁড়িওয়ালা একজন ‘টিপ পরছোস কেন’ বলেই বাজে গালি দিলেন। তাকিয়ে দেখলাম তার গায়ে পুলিশের পোশাক। একটি মোটরবাইকের ওপর বসে আছেন। প্রথম থেকে শুরু করে তিনি যে গালি দিয়েছেন, তা মুখে আনা এমনকি স্বামীর সঙ্গে বলতে গেলেও লজ্জা লাগবে। ঘুরে ওই ব্যক্তির মোটরবাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তখনো তিনি গালি দিচ্ছেন। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। একসময় আমার পায়ের পাতার ওপর দিয়েই বাইক চালিয়ে চলে যান। [প্রথম আলো, ২ এপ্রিল ২০২২]
গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে লতা সমাদ্দার জানিয়েছেন, আগেও তিনি এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এরআগেও হাতের শাঁখা নিয়ে দু-একজন বাজে মন্তব্য করেছেন, তবে তা তেমন গায়ে মাখিনি। তবে আগের মন্তব্যকারী সাধারণ মানুষ এবং আজকে পুলিশের পোশাক গায়ে দেওয়া ব্যক্তির বয়ান কিন্তু প্রায় একই বা কাছাকাছি, বলেছেন তিনি। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর পরও যদি এমন অবস্থা হয় তবে এটা মেনে নেওয়া যায় না, আক্ষেপ লতা সমাদ্দারের। এই আক্ষেপ কেবল লতা সমাদ্দারেরই নয়, এই আক্ষেপ সকলের।
টিপের সঙ্গে ধর্মের কী সম্পর্ক, কী বিরোধ; টিপের সঙ্গে সংস্কৃতির কী সম্পর্ক—ঘটনার পর পরই এনিয়ে অনেককে আলোচনা করতে দেখছি। এই আলোচনায় যুক্তি আছে, প্রতিবাদ আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুরুষ প্রতিবাদকারীদের অনেকের কপালে টিপও দৃশ্যমান। এই ধরনের প্রতিবাদ একদিক থেকে ইতিবাচক; আবার অন্যদিক থেকে ভাবলে এও প্রশ্ন জাগে—সংস্কৃতির দোহাই, ধর্মের দোহাই দিয়ে আমরা নারীর ব্যক্তিগত সাজসজ্জার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করছি না তো? এখানে কি নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করছি না? নারী ইচ্ছায় টিপ পরছে—এখানে যুক্তির কিছু নেই, এটাকে জায়েজ-নাজায়েজ বানানোরও কিছু নেই। এটা স্রেফ তার স্বাধীনতা, তার রুচি। এই রুচি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অধিকার কারও নেই। জননিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ প্রশাসনের কোনো সদস্যের নেই; কারও নেই। ব্যক্তির রুচি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের চেষ্টা পশ্চাৎপদ মনমানসিকতা প্রকাশ। যা এই পুলিশ সদস্য করেছেন।