রাজনীতির পঞ্চাশ বছর: আবুল মনসুর আহমদের অবলোকন
আবুল মনসুর আহমদকে পাঠ করা জরুরি। কেননা তাকে পাঠ করার মধ্য দিয়ে আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ ও মোক্ষম দাওয়াই পেতে পারি। আমাদের সমাজ-রাজনীতির চেহারা কেমন ছিল, আর কোথায় তা পাল্টেছে কিংবা পাল্টায়নি তার একটা পরিষ্কার বোঝাপড়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে লেখক আবুল মনসুর আহমদ আমাদের অন্যতম সহায়। তার লেখা 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' বইয়ের আলোকে এই লেখায় জারি থাকবে সেই প্রচেষ্টার সযত্ন প্রয়াস ও আন্তরিক অভীপ্সা।
রাজনীতির পঞ্চাশ বছর সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া কেন জরুরি, তা বুঝতে আবুল মনসুর আহমদসহ ৩ জনের শরণ নেবো।
আহমদ ছফার লেখায় আব্দুর রাজ্জাকের বয়ানে 'যদ্যপি আমার গুরু' বইয়ে উল্লিখিত হয়েছে, 'সেভেন্টি টুতে একবার ইউনিভার্সিটির কাজে তার লগে দেখা করতে গেছিলাম। শেখ সাহেব জীবনে অনেক মানুষের লগে মিশছেন তো আদব লেহাজ আছিল খুব ভালা। অনেক খাতির করলেন। কথায় কথায় আমি জিগাইলাম, আপনার হাতে তো অখন দেশ চালাইবার ভার, আপনে অপজিশনরে কী করবেন। অপজিশন ছাড়া দেশ চালাইবেন কেমনে। জওহরলাল নেহেরু ক্ষমতায় বইস্যাই জয়প্রকাশ নারায়ণরে কইলেন, তোমরা অপজিশান পার্টি গইড়্যা তোল। শেখ সাহেব বললেন, আগামী নির্বাচনে অপজিশান পার্টিগুলা ম্যাক্সিমাম ৫টার বেশি আসন পাইব না। আমি একটু আহত অইলাম, কইলাম, আপনি অপজিশনরে ১০০ সিট ছাইড়্যা দেবেন না? শেখ সাহেব হাসলেন। আমি চইল্যা আইলাম। ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার সুযোগ দিছিল। তিনি এইডা কামে লাগাইবার পারলেন না।'
'ঢাকা সেন্ট্রাল জেল নানা রঙের দিনগুলি' বইয়ে ডা. এম এ করিম ঠিক কাছাকাছি একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন। সেখানে উল্লিখিত হয়েছে, 'বহুদিন পরে শেখ মুজিবের সাথে দেখা। তিনি তখন জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী কত কী। কিন্তু শেখ মুজিব তেমনি আছেন। বললেন, কি রে তুই যে একবারও দেখা করতে এলি না, ব্যাপার কী বলত? বললাম, আমার প্রয়োজন থাকলে তো আসব। জিজ্ঞেস করলো কেমন আছি। বললাম ভালো। তারও কুশল জিজ্ঞেস করলাম। অনেক কিছুই আলাপ হলো। শেষে আমি বললাম, সামনে তো ইলেকশন। অন্তত ভাল দেখে ৫০ জন বিরোধী দলীয় সদস্যদের সংসদে আসতে দিও, ভাল হবে। শেখ তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন কীসের ভাল হবে বলতো? তুই কি আমার থেকে বাংলাদেশ বেশি চিনিস? আমি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়েছি, আমি সবগুলোকে চিনি। ওরা আমার কাছ থেকে গোপনে এসে টাকা নিয়ে যায়। টাকাও দেবো, সিটও দেবো তা কোনদিন হয়? হয় সিট, নয় টাকা। আমি বললাম তুমি যেটা ভাল বুঝবে করবে। আমার বলার ছিল বললাম। …আজকের রাজনীতির যে দুর্বৃত্তায়ন, তা শেখ মুজিবের সময় থেকে নতুন মাত্রা পেয়েছে। মুজিব জানতেন কিন্তু কোথায় যেন অসহায় ছিল অথবা পরোক্ষ প্রশ্রয় ছিল। অথচ আক্ষেপ করে বলতেন, সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।'
'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' বইয়ে আবুল মনসুর আহমদও ঠিক এরকম একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। তিনি যেহেতু রাজনীতিবিদ, সেই লেখায় তার ছাপও মেলে। তবে তার ভবিষ্যদ্বাণী পরিষ্কার ও স্পষ্ট এবং সংসদীয় রাজনীতিতে বিষয়টা কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে, সেই প্রসঙ্গেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং সেটা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, সময়ের পরিক্রমায় সেটা রূঢ় এক সত্য রূপেই উপস্থিত হয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনীতি
- সুবর্ণ জয়ন্তী
- আবুল মনসুর আহমদ