ভাষা ও প্রাণবৈচিত্র্য যমজ বোন
অভিন্ন যমজেরা যেমন হয়- একজন চোট পেলে আরেকজন কঁকিয়ে ওঠে। কারো বুকে ব্যথা হলে আরেকজন তড়পায়। ভাষা ও প্রাণবৈচিত্র্যও তেমনি অভিন্ন যমজ। একজন আরেকজনের সাথে জড়াজড়ি করে, পালককুসুম মেলে বিকশিত করে যোগাযোগের ময়দান। ভাষা তাই কোনোভাবেই একপাক্ষিক, একসূত্রীয় কোনো মাধ্যম নয়। আমাদের কাছে ভাষার একধরনের চলতি দৃশ্যমানতা এর প্রকাশভঙ্গি, বিরাজমানতা এবং পরিসরসমূহ। যতভাবে ভাষা বর্ণিত ও অবর্ণিত হয় তার সব খোলনলচেই অধিপতি ক্ষমতার তাবত বাহাদুরির কড়া শাসনে বন্দি। বনপাহাড় থেকে জন্ম নিয়ে উজান থেকে ভাটিতে সংসার সাজায় নদী। নদীসংসারের চারধার জুড়ে অববাহিকা থেকে অববাহিকায় সেই নদী ঘিরে নিম্নবর্গের জীবনে তৈরি হয় নদীভাষার এক অবিস্মরণীয় ব্যাকরণ।
লুটতরাজ রাষ্ট্র কী উন্নয়নের বাণিজ্যদম্ভ যখন সেই নদীকে ফালি ফালি করে হত্যা করে, গুম করে, দখল করে তখন কিন্তু নদীঅববাহিকার নদীভাষা বদলে যেতে বাধ্য হয়। নদী অববাহিকার আপন ভাষা তখন আর যোগাযোগের আপন 'ঠাহর' হিসেবে বিরাজিত থাকে না। ভাষা এমনই এক নিরন্তর বিকশিত জটিল প্রণালী যেখানে ভাষা টিকে থাকবার শর্ত ও কারিগরিগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ভাষার এ অনিবার্য ব্যাকরণকে অস্বীকার করে কোনোভাবেই 'মাতৃভাষার' মায়াকান্না চলে না। সাঁওতালি ভাষায় 'বীর' মানে অরণ্য-জংগল। একটা সময় দেশের উত্তরাঞ্চল জুড়ে গহিন শালঅরণ্য আর সাঁওতাল জনগণের অরণ্য-সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল। যে কারণে দিনাজপুর অঞ্চলের অনেক জায়গার নাম বীরগঞ্জ, বিরল, বীরটোলা, শারশা বীর। উল্লিখিত স্থাননামে 'বীর' শব্দটি থাকলেও শালবন ও সাঁওতালি সভ্যতা এখান থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। এই নিদারুণ অরণ্যহীনতা এ অঞ্চলের সাঁওতালি ভাষায় কোনো স্থাননামের ক্ষেত্রে আর কোনোদিনও 'বীর' শব্দটি ব্যবহৃত হবে না। দিনাজপুরের বীরগঞ্জের একটি সাঁওতাল গ্রামের নাম ছিল 'রাটেন আতো'। সাঁওতালি ভাষায় রাটেনআতো মানে গভীর অরণ্যের গ্রাম। বহিরাগত বাঙালিরা বনবিনাশ করে সাঁওতাল গ্রামটি দখল করে বর্তমানে এর নাম রেখেছে 'মাটিয়াকুড়া'। চলতি সময়ে সাঁওতালি ভাষায় 'রাটেনআতো' কেবলমাত্র এক বহুদূরের স্মৃতি। নতুন প্রজন্মের সাঁওতালি ভাষায় এ শব্দধারণাটি একেবারেই অপ্রচলিত।