![](https://media.priyo.com/img/500x/https://samakal.com/uploads/2022/01/online/thumbnails/shirajul-islam-chowdhory-samakal-61f188b4a46ea.jpg)
সর্বস্তরে বাংলা চালু হলো না কেন
আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট দাবি দুটির একটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই; অপরটি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই। পেছন ফিরে তাকালে প্রশ্ন উঠতে পারে- দুটি দাবি কেন তোলা হলো; একটিই তো যথেষ্ট হওয়ার কথা। রাষ্ট্রভাষা যদি বাংলা হয় তাহলেও সর্বস্তরে তার প্রচলন ঘটবে কি ঘটবে না সে-বিষয়ে কোনো সংশয় ছিল কি? জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ; ছিল। প্রথমত, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে- এমন দাবি পূর্ববঙ্গের মানুষ তোলেনি। তারা চেয়েছে বাংলা হবে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা।
অর্থাৎ দুটির একটি; তাই বাংলাকে যদি রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে মেনে নেওয়া হলেই যে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হয়ে যাবে- এমন ভরসা কোথায়? ভরসা নেই বলেই বোধ হয় রাষ্ট্রভাষা দাবির সঙ্গে বাংলা প্রচলনের দাবিটাও উঠেছিল। অখণ্ড পাকিস্তানে বাংলাকে শেষ পর্যন্ত অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু নতুন জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ বাঙালি ওই মেনে নেওয়াতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। যে জন্য ধাপে ধাপে এগিয়ে এবং পূর্ণ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির প্রয়োজনে তারা এমন একটি রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে যার অন্যতম নয়, একমাত্র রাষ্ট্রভাষাই বাংলা। কিন্তু তার পর? বাংলা কি সর্বস্তরে প্রচলিত হয়েছে? হয়নি যে, সেটা তো পরিস্কার।
দেশের শাসকশ্রেণি বাংলা ব্যবহারে আগ্রহী নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এ দেশের শাসকশ্রেণি বাংলা ভাষার ব্যাপারে কখনোই উৎসাহী ছিল না। অতীতে আমরা পরাধীন ছিলাম; বিদেশিরা আমাদের শাসন করেছে। তারা বাংলা ভাষা ব্যবহার করবে না বরং তাদের নিজেদের ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইবে- এটাই ছিল স্বাভাবিক। এ জন্য আমরা দেখেছি সংস্কৃত, ফার্সি এবং পরে ইংরেজি হয়েছে সরকারি ভাষা; বাংলা ভাষা সে মর্যাদা পায়নি। পাকিস্তানিরা চেয়েছিল, উর্দুকে চাপিয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত পারেনি। কিন্তু এখন তো দেশ শাসন করছে স্বদেশিরা। তাহলে এখনও কেন বাংলা সর্বত্র প্রচলিত হচ্ছে না?
না হওয়ার ঘটনা এই মর্মান্তিক সত্যের প্রতিই ইঙ্গিত করে- আমাদের শাসকশ্রেণি এ দেশেরই; যদিও তবু তারা ঠিক দেশি নয়। তারা জনগণের সঙ্গে নেই। নিজেদেরকে তারা জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করে, কিন্তু তাদের ভেতর দেশপ্রেমের নিদারুণ অভাব। তাদের সংযোগ যে পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গে; তার ভাষা স্পষ্টরূপে ইংরেজি। বাংলা জনগণের ভাষা; চিরকালই তাই ছিল; এখনও সে রকমই আছে। কিন্তু শাসকরা জনগণ থেকে দূরেই রয়ে গেছে, যেমন তারা আগে ছিল।
শাসকশ্রেণির সন্তানরা ইংরেজি শেখে; তারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে; বিদেশে ঘরবাড়ি কেনে এবং তাদের সন্তানরা বিদেশমুখো হয়। তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতেও বিদেশিদের হস্তক্ষেপ ঘটছে। শাসকশ্রেণি তাতে বাধা দেবে কি, তাদেরকে তোয়াজ করে চলে। বাংলার প্রচলনের অন্তরায় অন্য কেউ না; জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে দেশের বিদেশমুখো ও বিদেশ-প্রভাবিত শাসকরাই এর অন্তরায়। শাসকশ্রেণির ভেতর রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা, পেশাজীবী সবাই আছে। তাদের প্রধান যোগ্যতা, তারা ধনী। তারা ইংরেজি ব্যবহার করতে পারলে খুশি হন এবং যখন বাংলা ব্যবহার করেন তখন মনমরা থাকেন এবং ভাষাকে বিকৃত করেন।