বৈষম্য বৃদ্ধিতে কেন্দ্রীভূত ব্যাংকঋণ ভূমিকা রাখছে
কয়েক দিন আগে বণিক বার্তায় ব্যাংক সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। খবরটির শিরোনাম করা হয়েছে, ‘বড় গ্রাহকদের খেলাপিমুক্ত রাখা এখন দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার অন্যতম কাজ।’ দৃশ্যত খবরটি খেলাপি ঋণে বোঝা ও ব্যাংকের সমস্যা সম্পর্কিত। তবে প্রতিবেদনের ভেতরে বেশকিছু খবর আছে, যা কোনোভাবেই আশাপ্রদ নয়। যেমন সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বড় বড় গ্রাহকের অনেকেই ৩০-৩৫টি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। মোট ১০০ জন গ্রাহকের কাছে ব্যাংকঋণ কেন্দ্রীভূত। বড় বড় গ্রাহকের শতশত কোটি টাকার সুদ মওকুফ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অনেক সময় ব্যয় হচ্ছে বড় বড় গ্রাহককে নিয়ে। স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পর জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩০ শতাংশ ব্যাংক সেবার আওতায় এসেছে। আরো নিরাশার খবর, জনগণের মাত্র ৫ শতাংশ ব্যাংকঋণের আওতায় এসেছে। কেন এ অবস্থা—এর কথা বলতে গিয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ৬১টি ব্যাংকের প্রতিযোগিতাই এর মূল কারণ। বড় বড় ঋণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কথা হচ্ছে, বন্ধক রেখে এবং নিয়ম মেনে ঋণ দিলে কোনো অসুবিধা নেই। মোটা দাগে এই হচ্ছে প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বলাবাহুল্য, উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রত্যেকটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে এদের ওপর আলাদা আলাদা মন্তব্য কলাম লেখা যায়। এটা এখানে সম্ভব নয় বিধায় আমি একটি বিষয় দিয়ে আজকের কলাম শুরু করছি।
সবার চিন্তার বিষয় একটা। ব্যাংকঋণের বৃহদাংশ কেন্দ্রীভূত ১০০ জন ঋণগ্রহীতার কাছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য অবস্থা নয়। নীতিগতভাবে নয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবেও নয়। সমতা বিধান, বৈষম্য নিরসনের দৃষ্টিকোণ থেকেও তা কাম্য নয়। অথচ এটা ঘটেছে। পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭-৭১) ২২ পরিবারের কাছে আমরা জিম্মি ছিলাম। ব্যাংক ব্যবস্থাও ছিল তাদের হাতে। এ কথা মনে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথম থেকেই বৃহৎ ঋণের ব্যাপারে সতর্ক ছিল। তারা ‘বৃহৎ ঋণের’ সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়। একজন গ্রাহককে সর্বোচ্চ কত টাকা ঋণ দেয়া যাবে, তাও সার্কুলার দ্বারা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। একে অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য তারা বারবার নির্দেশনা দিয়ে এসেছে। ব্যাংকের নিরীক্ষার (অডিট) পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ কেন্দ্রীভূতকরণের ব্যাপারে সাবধান করে দিচ্ছে। ‘সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার’ শব্দটি ব্যাংকে অতি পরিচিত। ব্যাংকের মূলধন কত, এর কত অংশ একজন গ্রাহককে দেয়া যাবে, তা বলা আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে। তার পরও আজ কেন এমন অবস্থা? ব্যাংকঋণের বৃহদংশ ১০০ জন গ্রাহকের হাতে কেন? এতে কত টাকা হয়? ব্যাংকে মোট আমানত আছে প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকা। এর ২০ শতাংশের মতো টাকা ‘লিকুইডিটি’ হিসেবে রেখে বাকি টাকা গ্রাহককে ঋণ দেয়া যায়। তাহলে বুঝুন কত টাকা মোট ব্যাংকঋণ এবং বৃহদংশই ১০০ গ্রাহকের কাছে কেন্দ্রীভূত। তাও আবার তারা একেকজন ঋণ নিয়েছে ৩০-৩৫টি ব্যাংক থেকে। ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতা করে তাদের ঋণ দিয়েছে। তা না হলে বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি হয় কীভাবে? এত সার্কুলার, নির্দেশনা, অডিট আপত্তির কী হলো? ব্যাংকগুলো কোন সাহসে বড় বড় ঋণ দিয়ে ১০০ জনের কাছে জিম্ম্নি হলো? জিম্মি হয়ে এখন ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিল করছে, ঋণ পুনর্গঠন করছে, নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের ‘জিন্দা’ রাখার চেষ্টা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব পালনের কী হলো? ব্যাংকঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়ার জন্য যে বিপদের সৃষ্টি হয়েছে তার দায়দায়িত্ব কার? এর বিচার-আচার কি সম্ভব?