সবুজ শক্তিতে নিরাপদ পানি
কয়েক ঢোক সুপেয় পানির জন্য অপেক্ষা করছেন ৬০ বছর বয়সী আবদুল গফুর। লবণাক্ত ও তেতো নয়, এমন পানির জন্য সাগ্রহ অপেক্ষা এই বৃদ্ধের। বঙ্গোপসাগরের কাছেই উপকূলীয় গ্রাম শরণখোলার বাসিন্দা আবদুল গফুর। পুরো গ্রামটিকেই লবণাক্ত ও তেতো স্বাদের পানি পান করতে হয়।
নাতির স্কুল থেকে ফেরার জন্য এই অপেক্ষা আবদুল গফুর। ফেরার সময় সুপেয় পানি নিয়ে ফিরবে তার নাতি। তার স্কুলে লবণাক্ত পানিকে মিষ্টি সুপেয় পানিতে পরিণত করার জন্য একটা যন্ত্র স্থাপন করার পর থেকে প্রতিদিন সে স্কুল থেকে ফেরার সময় পানি নিয়ে ফেরে।
টিনের ছাউনির ঘরের বাইরে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মিতুলের পায়ের আওয়াজ শোনা যেতে হাসি ফুটে ওঠে বৃদ্ধ গফুরের মুখে।
'আহ, চলে এসেছে আমার পানি। মিষ্টি পানি,' বলে ওঠেন গফুর। গত এক দশকে বলেশ্বরী নদীর জোয়ার আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠায় কয়েকবার বসতবাড়ি বদলাতে হয়েছে এই জেলে পরিবারকে।
ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণ ঢুকে পড়ায় এই অঞ্চলের নদী ও ভূগর্ভস্থ পানি প্রতি বছর আগের চেয়ে লবণাক্ত হয়ে পড়ছে।
'দাদা, তোমার পানি,' দাদার বিছানায় বহুল ব্যবহৃত এক লিটারের মিনারেল পানির ওয়াটারের বোতলটা ফেলে বলে মিতুল। পরক্ষণেই ছুটে বেরিয়ে যায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিতে।
বোতল থেকে বড় এক ঢোক পানি খান গফুর। ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে তারা শুভ্র দাড়ি বেয়ে।
'কী করব বলেন, মিতুলের স্কুলের পানির প্ল্যান্টটা ছাড়া আশেপাশে মিষ্টি পানির আর কোনো কোনো উৎস নেই,' ক্লান্ত কণ্ঠে বলেন গফুর।
অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা একটি অভিনব কিন্তু সহজ ও কার্যকর প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে পূর্ব খন্তাকাটায় মিতুলের স্কুলের ছাদে সূর্যের আলো নদীর লবণাক্ত পানিকে মিষ্টি সুপেয় পানিতে পরিণত করছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর-এর (ডিপিএইচই) 'পরিবেশবান্ধব সোলার ডিস্যালিনেশন সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহ' শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে নেওয়া একটি সবুজ পাইলট প্রকল্পের আওতায় ১৬টি উপকূলীয় জেলায় এক হাজার ১৪০টি সৌর ডিস্যালিনেশন ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে।
এই ইউনিটগুলোর বেশিরভাগই প্রকল্প-অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুলের ছাদে স্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে দুটি পর্যন্ত সোলার ইউনিট দেওয়া হয়—প্রতি ইউনিটে পাঁচটি করে প্যানেল থাকে।
মিতুলের স্কুল ১০৫ নং খন্তাকাটা ইউনাইটেড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদে স্থাপিত সৌর ডিস্যালিনেশন ইউনিটটি ১৭০ জন শিক্ষার্থীর জন্য পর্যাপ্ত সুপেয় পানি তৈরি করে।
স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ফরিদ আহমেদ বলেন, 'পাঁচ প্যানেলের ইউনিটটা প্রতিদিন প্রায় ১০০ লিটার পানি বিশুদ্ধ শোধন করে। আমরা খুব খুশি, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি পায়।'
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় নারী ও শিশুদের প্রতিদিন দীর্ঘ পথ হেঁটে খাবার পানি আনতে হয়।
স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য ছাদে পানি বিশুদ্ধিকরণ যন্ত্র স্থাপন দারুণ খুশির ব্যাপার।
উপকূলীয় অঞ্চলের গ্রামগুলোর বাসিন্দারা খাবির পানির জন্য অনেকাংশেই পন্ড স্যান্ড ফিল্টারের (পিএসএফ) ওপর নির্ভরশীল। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার পর অনেক পিএসএফ অচল হয়ে গেছে। সে কারণে কমে গেছে স্বাদু পানির উৎসের সংখ্যা।
ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্টগুলো মূলত শিক্ষার্থীদের জন্য স্থাপন করা হলেও আশপাশের পরিবারগুলোও মাঝেমধ্যে এসব প্ল্যান্ট থেকে পানি সংগ্রহ করে।