প্রথম তারার খোঁজে উড়ছে জেমস ওয়েব, সফল উৎক্ষেপণ
আজ বিজ্ঞানেরও বড়দিন। বাংলাদেশ সময় ঠিক সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে উড়াল দিলো মহাকাশবিদ্যার ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী টেলিস্কোপ— জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। নাসার অ্যাপোলো প্রোগ্রামের প্রধান বিজ্ঞানী জেমসের ওয়েবের নামের সঙ্গে মিল রেখে ছোট করে যাকে সবাই ওয়েব নামেই ডাকছে। হাবলের চেয়েও অনেক অনেক শক্তিশালী এই টেলিস্কোপ। চোখ রাখবে সুদূর অন্তরীক্ষে। বিজ্ঞানীরা বসে আছেন তীর্থের কাকের মতো। প্রথম তারার প্রথম আলোর একটা ঝলক দেখার আশায়।
দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরপূর্ব উপকূলের ফ্রেঞ্চ গিয়ানার ইউরোপিয়ান আরিয়ান রকেটে করে কক্ষপথের দিকে ছুটতে শুরু করে ওয়েব। আর এ মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য বিজ্ঞানীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩০ বছর! সব ঠিকঠাক থাকলে একবিংশ শতকের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক অভিযান হবে এটাই।
যাত্রাপথে বলতে গেলে এখন পর্যন্ত কোনও সমস্যা হয়নি। উৎক্ষেপণ দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করছে নাসা। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের উৎক্ষেপণ সফলভাবে সম্পন্ন করে এখন টেলিস্কোপটি আছে তৃতীয় ধাপে।
রকেট উৎক্ষেপণের আগেই বিজ্ঞানীরা একটি প্রত্যাশিত গতিপথ আঁচ করেছিলেন। জেমস ওয়েব ঠিক সেই পথেই এগিয়েছে। এতে নাসার বিজ্ঞানীদের মধ্যে দেখা দেয় উচ্ছ্বাস। আনন্দের আতিশয্যেও কেঁদেও ফেলেন কেউ কেউ।
প্রথমে সোজা উপরের দিকে ওঠার পর প্রত্যাশিত পথ অনুযায়ী টেলিস্কোপটি পৃথিবীর সমান্তরালে আসে। এরপর কিছুটা নেমে আবার উপরের দিকে উঠতে থাকে।
দুই সপ্তাহের আতঙ্ক
এখনও মহাকাশের দিকে রকেট ছুড়তে গেলে মনে শঙ্কা জাগে, ঠিকঠাক উড়াল দিতে পারবে তো? জেমস ওয়েব বিশালাকার টেলিস্কোপ হলেও এখন সেই শঙ্কা থেকে অনেকটাই মুক্ত। কয়েক ভাঁজে ভাঁজ করে এটাকে রকেটের মাথায় পুরে দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর আকর্ষণ বলয় অতিক্রম করতে এর সময় লেগেছে ২৭ মিনিট। এর মধ্যে এর সর্বশেষ থ্রাস্টটিও বন্ধ হয়। রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে টেলিস্কোপটির সোলার প্যানেলও খুলেছে সময়মতো।
কক্ষপথে গেলেই কাজ শেষ নয়। টেলিস্কোপটাকে ডানা মেলতে হবে বেশ সময় নিয়ে। প্রায় ৩০০টি খুঁটিনাটি যন্ত্রাংশ ধীরে ধীরে খুলবে। খোলার পর এর আকার হবে একটি টেনিস কোর্টের সমান। তবেই কাজ করবে এক হাজার কোটি ডলার খরচ করে বানানো টেলিস্কোপটা। এর মধ্যে কোনও একটায় গড়বড় হলেই সেরেছে। পুরো প্রকল্পই যাবে ভেস্তে। আর পুরোদমে কাজ শুরু করতে জেমস ওয়েবের সময় লাগবে প্রায় দুই সপ্তাহ।
কী খুঁজবে ওয়েবের চোখ?
বসে বসে দেখা ছাড়া টেলিস্কোপের বিশেষ আর কাজ নেই। ৩০ বছর ধরে হাবলও ওই কাজই করেছিল। উপহার দিয়েছিল মহাকাশের দারুণ সব ছবি। তবে জেমস ওয়েবের চোখ আরও সূক্ষ্ম, আরও বড় আয়না। তাতে ধরা পড়তে পারে মহাবিশ্ব সৃষ্টির সেই আদ্যিকালের ছবি। কোটি কোটি আলোকবর্ষ থেকে ছুটে আসা প্রথম দিককার নক্ষত্রের আলো শনাক্ত করার ক্ষমতাও আছে এর। অনায়াসে দেখতে পাবে দূরের গ্যালাক্সি, গ্রহ-নক্ষত্র। আরও নিখুঁতভাবে বলতে পারবে, কোন গ্রহ বাসযোগ্য, কোনটি নয়।
প্রাথমিকভাবে ওয়েব মহাকাশে তাকাবে তার ইনফ্রারেড চোখ দিয়ে। মানে খালিচোখে যা দেখা যাবে না, সেটাই দেখবে অনায়াসে। চারটি যন্ত্রের সমন্বয়ে ছবি তুলবে এটি। কাভারেজে থাকবে ০.৬ থেকে ২৮ মাইক্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য (হাবল টেলিস্কোপের ছিল ০.৮ থেকে ২.৫ মাইক্রন)।
নাসা আশা করছে, এত সূক্ষ্ম চোখে মহাকাশে নানা ধরনের বস্তু কণা ও বিল্ডিং ব্লক তৈরির রহস্য এবার ধরা পড়বেই। আর এতে করে বোঝা যাবে দূরের গ্যালাক্সিতে আদৌ অন্য কোনও প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা।
হাবল বনাম ওয়েব
দীর্ঘদিন মহাকাশবিজ্ঞানীদের ছবি পাঠিয়েছে হাবল। বেশ ক’দিন হলো অবসরে গেছে টেলিস্কোপটা। সময়ের বিচারে জেমস ওয়েব যে দৌড়ে অনেক এগিয়ে থাকবে সেটা জানা কথা। হাবল যেখানে পৃথিবীর ৫৭০ কিলোমিটার উপরে চক্কর খেতো, সেখানে জেমস ওয়েব যাবে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরের এল-২ ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট অরবিটে। এ পথ পাড়ি দিতেই লাগবে প্রায় ৩০ দিন।
হাবলের আয়নার ব্যাস ২.৪ মিটার। দেখতে চাকতির মতো। জেমসে ওয়েবে আছে ষড়ভূজাকৃতির ১৮টি আয়না। যার ব্যাস সাড়ে ৬ মিটার। বিশালাকার এ আয়না দেখতে পাবে বিগ ব্যাংয়ের পর ডার্ক এইজ পেরিয়ে নক্ষত্র সৃষ্টির শুরুর দিককার দৃশ্য।