কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

মানবজমিন প্রকাশিত: ১৩ জুন ২০২১, ০০:০০

কিশোর গ্যাং আতঙ্কে সন্ত্রস্ত সরাইলের অরূয়াইল। হত্যা চুরি ছিনতাই মাদক ডাকাতি কোনো কিছুতেই পিছিয়ে নেই তারা। তাদের কাছে অসহায় পিতামাতাও। আর এ দলের প্রধান গাজী নাঈম ওরফে ছুরি নাঈম। বয়স মাত্র ১৯ বছর। গত ৮ই জুন গ্যাংয়ের অন্যতম সদস্য সুমনের লাশ উদ্ধার হওয়ার পর ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে এ গ্যাংটি। শুধু সুমন নয়; এর আগে ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছে পাকশিমুলের দেলোয়ার। দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে ১১-১২ সদস্যের ওই কিশোর গ্যাং। এরা নিজেদের আড়াল করতে দিনে বের হয় মুখোশ পরে। আর রাতে সর্বত্র থাকে সরব। সুমন নিহতের পর আত্মগোপনে চলে গেছে গ্রুপের সবাই। অনুসন্ধানে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় তিন বছর আগে উপজেলার অরূয়াইলে জন্ম নিয়েছে কিশোর গ্যাং। টিনএজারদের নিয়ে সংগঠিত গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা ১১-১২ জন। সহযোগী রয়েছে আরো ৫-৭ জন। গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছে অরূয়াইলের শামছু মিয়ার ছেলে নাঈম। সেকেন্ড ইন কমান্ড নাসিরনগর উপজেলা গুজিয়াখাইল গ্রামের কালন মিয়া (২৫)। নাঈম এলাকায় ও প্রশাসনের কাছে ছুরি নাঈম হিসেবেই পরিচিত। গ্যাংয়ের অধিকাংশ সদস্যই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। অভিভাবকদের কোনো পাত্তা দেয় না তারা। অনেকে মাদকের টাকার জন্য পিতামাতাকে লাঞ্ছিত করছে। গ্রুপের সব সদস্যের কাজই হচ্ছে চুরি ছিনতাই ডাকাতি খুনখারাবিসহ নানা অপরাধমূলক কাজ। রাতের অরূয়াইলের মালিক ওই বাহিনী। অধিকাংশের হাতে থাকে ধারালো ছুরি। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে সেবন করে মাদক। জড়িয়ে পড়ে অপকর্মে। ছুরিকাঘাত করে টাকা ও মালামাল লুট। অরূয়াইল বাজার, অরূয়াইল-চাতলপাড় সড়ক ও পাকশিমুল সড়কে চলে তাদের সব ধরনের অপকর্ম। সন্ধ্যার পর ওই সড়ক দুটিতে কোনো পথচারী নিরাপদ নয়। ছুরি ধরে নগদ টাকা, মুঠোফোনসেট ও স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেয়া এদের জন্য মামুলি ব্যাপার। ১০-১২ দিন আগে কাজ শেষে রাত ১টার দিকে বাড়ি যাওয়ার পথে বারপাইকা গ্রামের রাজমিস্ত্রী জাকিরের মুঠোফোনসেট ও নগদ ১৫ হাজার টাকা নিয়েছে নাঈম বাহিনী। জনৈক কিশোরকে ছুরিকাঘাত করে ২০ হাজার টাকা মূল্যের মুঠোফোনসেট ও এক মহিলার কানের স্বর্ণালঙ্কারও ছিনিয়ে নিয়েছে ওই বাহিনী। গত রমজানের ঈদের আগের দিন ভোরবেলা সিএনজি স্ট্যান্ডে শাহিন (১৮) নামের এক কিশোরকে আটক করে নাঈম বাহিনীর ৩ সদস্য। কিশোরের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা মূল্যের ফোনসেট ছিনিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। ক্ষুব্ধ হয়ে তারা কিশোরকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে। নাঈম বাহিনী চষে বেড়াচ্ছে পাকশিমুল এলাকাও। গত দেড়-দুই মাসে গরু চুরি ও ছুরিকাঘাতে ২টি হত্যাকাণ্ডসহ ওই এলাকায় ১০টি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। অপরাধ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে গত মঙ্গলবার বিকালে ধামাউড়া ঈদগাহ মাঠে সাবেক ইউপি সদস্য ছান্দালী মিয়ার সভাপতিত্বে এক সভায় বসে গ্রামবাসী। সভায় ছুরিকাঘাত চুরি ছিনতাইয়ের বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেন লোকজন। চোর শনাক্ত করে হারুন মিয়ার চুরি হওয়া গরু ২টি উদ্ধার করে বুঝিয়ে দেয়া হয়। গরু চোর নাঈম বাহিনীর অন্যতম সহযোগী নুরুল্লাহ সভায় না এসে পালিয়ে যায়। চুরির ঘটনা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় নাঈম বাহিনীর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব লেগে যায়। দু’গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে ওই কিশোর গ্যাং। পরের দিন বুধবার সকালে অরূয়াইল-চাতলপাড় সড়কের শোলাকান্দি এলাকায় সুমনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। এ ব্যাপারে থানায় ইউডি মামলা হয়েছে। সুমনের বাবা নাসির মিয়া বলেন, সুমন আমার কন্ট্রোলে ছিল না। তারও একটি গ্রুপ ছিল। অতিরিক্ত মাদক সেবন করে সুমন মারা গেছে। আমাকে জ্বালিয়ে শেষ করে ফেলেছে। আমার ১৫ লাখ টাকা শেষ করেছে। কাতার পাঠিয়েছিলাম। একটি টাকাও দেয়নি। এসে পড়েছে। আমাকে মারধর করেছে। ইউএনও স্যারের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি। তাই বাড়ি থেকে চলে গেছে। আর আসেনি। কোথায় থাকতো আমি জানি না। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, রাতে নাঈমের নেতৃত্বে ৬-৭ জন কিশোরকে এই ব্রিজে বসে মাদক সেবন করতে দেখেছি। একে অপরের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার শব্দও শুনেছি। সকালে দেখি ব্রিজের নিচে এক কিশোরের লাশ। সুমনের সহপাঠী দাবি করে এক কিশোর বলেন, নিহত সুমনের এনরয়েড মুঠোফোন সেট ও তার সঙ্গে থাকা টাকাগুলো গেল কোথায়? ওইদিন রাত ১২টার পর থেকে সুমনের ফেসবুক আইডি বন্ধ কেন? এসব খুঁজলেই সুমন নিহতের আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। অরূয়াইল ইউপি আওয়ামী লীগের সম্পাদক এডভোকেট শফিকুর রহমান অপরাধ বিষয়ে সভা করার কথা স্বীকার করে বলেন, কম বয়সী ১১-১২ জনের একটি দল এলাকায় চুরি ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেকদিন ধরে। এরা মাদকও সেবন করে। চুরি হওয়া গরু ২টি উদ্ধারও করেছি। নুরুল্লাহর একটি ঘরে বসে রাতে ওই কিশোররা আড্ডা দেয়। তাই ওই দোকানটিও আমাদের হাতে নিয়ে এসেছি। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য যারা: স্থানীয় ভুক্তভোগীদের দেয়া তথ্য মতে, অরূয়াইলে গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ১২ জনের বেশি। অরূয়াইলের বিভিন্ন গ্রামের কিশোরদের সঙ্গে রয়েছে সীমানা সংলগ্ন নাসিরনগরের ২-৩ জন কিশোর। গ্যাংয়ের নেতা নাঈম ওরফে ছুরি নাঈম, সেকেন্ড ইন কমান্ড গুজিয়া খাইল গ্রামের কালন। অপর সদস্যরা হলো- বাদে অরূয়াইলের মেরাজ মিয়ার ছেলে ইকবাল (১৭), মরম আলীর ছেলে শাহ আলম (১৮), আব্দুর রহমানের ছেলে সোহেল (১৭), অরূয়াইলের ওমর আলীর ছেলে রূবেল মিয়া (২২), রাশিদ মিয়ার ছেলে দানু (২২), মহরম আলীর ছেলে কালন মিয়া (২৫), ধামাউড়ার মাহাবুর মিয়ার ছেলে সুলতান (১৮), পাকশিমুলের সাইকুল ইসলামের ছেলে বায়েজিদ (১৮), জাকির (২৭) ও বড়ইছাড়া গ্রামের ছায়েব আলীর ছেলে সাইকুল (২৩)। সহযোগীরা হলো- বরকত (২৯), কামরুল (২৭), নূরুল্লাহ (৩১) ও আক্তার (৩২)। তবে পুলিশ বলছে গ্যাংয়ের ৮ সদস্যের নাম পেয়েছে। নাঈমের পিতা সামছুর কান্না: ছেলের অপকর্ম অকপটে শিকার করে কাঁদতে শুরু করেন বৃদ্ধ সামছু মিয়া (৭০)। তিনি বলেন, নৌকা চালিয়ে সংসার চালিয়েছি। অনেক কষ্ট করেছি। গ্রামের স্কুলে একটু পড়ার পর আর স্কুলে যায়নি নাঈম। গত ৩ বছর ধরে আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। প্রথম দিকে টাকার জন্য আমাকে মারধর করতো। মাদক নিরাময় কেন্দ্রে রেখেছি ৬ মাস। জেলে রেখেছি ৪ বারে ১৬ মাস। এরপরও পারিনি। গত ৩-৪ মাস ধরে বাড়ি যায় না। কোথায় থাকে? কি করে? কিছুই জানি না। অরূয়াইল ইউপি যুবলীগের সাবেক সম্পাদক জাবেদ আল হাসান বলেন, এখানে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ প্রবণতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড় গোত্রের ছেলে হওয়াতে কেউ প্রতিবাদ করছে না। অরূয়াইল ইউপি চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, নাঈমের নেতৃত্বে কিশোর গ্যাংয়ের ত্রাসের রাজত্ব চলছে। গ্রুপটি খুবই বেপরোয়া। শুধু চুরি ছিনতাই ও ডাকাতি নয়। সর্বময় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঘোরে। প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি ও সেবন করে। অগণিত নারীকে নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছে। লজ্জা ও প্রাণনাশের ভয়ে কেউ প্রকাশ করছে না। এদের রয়েছে গডফাদার ও মদতদাতা। তাদের বিচার হওয়া উচিত। পুলিশ ক্যাম্প না থাকার সুযোগে তাদের অপকর্ম আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। অরূয়াইল ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা এসআই মো. মিজানুর রহমান সেখানে কিশোর গ্যাং থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, আপাতত ৮ জন সদস্যের নাম পেয়েছি। আমরা তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত