ভ্যাকসিন পাসপোর্ট

সারাক্ষণ জাকারিয়া স্বপন প্রকাশিত: ১১ এপ্রিল ২০২১, ১০:২৬

সম্প্রতি ভ্যাকসিন পাসপোর্ট নিয়ে বেশ কথা শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশে নয়, মূলত বিদেশেই এই ধারণার জন্ম হয়েছে এবং সেই বাতাস বাংলাদেশেও লেগেছে। অনেকের মনেই নানান ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, তাদের নতুন করে পাসপোর্ট ইস্যু করা হবে, যা তাদের বিদেশ গমনের সময় লাগবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এটা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে এবং অনেক রাষ্ট্রপ্রধান এটা নিয়ে কথা বলছেন। তাই এই পাসপোর্টের বিষয়টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি।


২.


ভ্যাকসিন পাসপোর্ট কোনো কাগজের পাসপোর্ট নয়। আমরা প্রচলিতভাবে যে পাসপোর্ট দেখে অভ্যস্ত, এটা তা নয়। মূলত এটা কোনো ধরনের পাসপোর্টই নয়। শুধু ‘পাসপোর্ট’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে, যেহেতু এটা অনেকটা প্রচলিত পাসপোর্টের মতোই কাজ করে। তবে আবারো বলছি, কেউ যেন এটাকে সবুজ পাতার বাংলাদেশের পাসপোর্টর মতো কিছু মনে না করেন।


এটা হলো একটি ছাড়পত্র, যার মাধ্যমে প্রমাণ করা যাবে যে আপনি ভ্যাকসিন দিয়েছেন। এটাকে একধরনের সার্টিফিকেট বলতে পারেন। তবে এটা ছাপানো কোনো সার্টিফিকেট নয়। আপনার টিকা দেয়ার তথ্যটি ডিজিটাল করে সেটা আপনার স্মার্টফোন অ্যাপের ভেতর কিংবা কিউআর কোড দিয়ে দেয়া হলো। যেখানে আপনার কোভিড পরীক্ষার ফলাফলও থাকতে পারে। মূলত একটি ডিজিটাল সিগনেচার, যার মাধ্যমে অন্য পক্ষ বুঝতে পারবে- আপনার টিকা দেয়ার স্ট্যাটাসটা কী!


তবে এখানে বলে রাখা ভালো, পৃথিবীর অনেক দেশ ডিজিটাল পাসপোর্ট চালু করেছে, যে পাসপোর্ট আপনি আপনার মোবাইল ফোনে নিয়ে নিতে পারেন এবং সেটা নিয়ে বর্ডার ক্রস করতে পারবেন, বিমানবন্দর দিয়ে অনায়াসে চলে যেতে পারবেন। ওখানে ওই পাসপোর্টটি পড়ার মতো যন্ত্র বসানো আছে। এবং সেটা প্রকৃত অর্থেই পাসপোর্ট। আপনার যেমন সবুজ পাসপোর্ট রয়েছে। এটাকে এখনো ডিজিটাল করা হয়নি। তবে একসময়ে বাংলাদেশের এই সবুজ পাসপোর্টও ডিজিটাল হয়ে যাবে।


কিন্তু এখন আমরা টিকার যে পাসপোর্টের কথা বলছি, সেটার ওই পাসপোর্টের সঙ্গে কোনো মিল নেই। এটা হলো কেবল আপনি টিকা নিয়েছেন কি না, সেটা বোঝার জন্য একটি ডিজিটাল সার্টিফিকেট- যা আপনি কোথাও দেখালে তাদের কাছে যদি ওই যন্ত্র থাকে, তাহলে আপনার এই ডিজিটাল সার্টিফিকেটটি পড়ে বুঝতে পারবে, আপনি টিকা দিয়েছেন। নইলে আপনার টিকা দেয়া কার্ডটি পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হতে পারে।


তবে আপনার টিকা দেয়ার তথ্য যেহেতু বাংলাদেশ সরকারের কাছে আছে, তাই তারাই আপনার টিকার তথ্যসহ একটি কিউআর তৈরি করে আপনাকে দিতে পারবে, যা আপনি আপনার স্মার্টফোনের অ্যাপের ভেতর রেখে দেবেন। এবং এটা শুধু পড়তে পারবে আরেকটি অ্যাপ দিয়ে।


অনেকেই ভাবতে পারেন, আপনার এই টিকা দেয়ার তথ্য বিদেশে গেলেও কেউ দেখতে পারবে কি না? এখন পর্যন্ত এই ভ্যাকসিন পাসপোর্ট প্রতিটি দেশ তার নিজেদের জন্য করছে। গ্লোবাল তথ্যভাণ্ডার হিসেবে এটা ব্যবহার হবে কি না, সেটা এখনো নিশ্চিত না। কারণ এখানে অনেক প্রাইভেসিসংক্রান্ত বিষয় জড়িত রয়েছে।


৩.


বাংলাদেশে ততটা না হলেও পৃথিবীর অনেক দেশ প্রাইভেসির বিষয়ে খুবই সেনসিটিভ। তারা এখনই সরকারকে জিজ্ঞেস করছে, কীভাবে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য ওই অ্যাপের ভেতর রাখা হচ্ছে এবং কীভাবে আরেকটি প্রতিষ্ঠান সেটা দেখতে পাচ্ছে, সেগুলো পরিষ্কার করার জন্য। এবং এই একটি কারণেই অনেক দেশে ভ্যাকসিন পাসপোর্ট নিয়ে কিছুটা বিতর্ক তৈরি হয়েছে।


আবার এই পৃথিবীতে এমন মানুষও অনেক আছেন, যারা সুযোগ পেয়েও টিকা নিচ্ছেন না। এটা বাংলাদেশে যেমন আছে, বিশ্বের অনেক দেশেই আছে। এখন তারা বিষয়টি নিয়ে চিৎকার করছে এই বলে যে, তারা যেহেতু টিকা দেয়নি, তাই এ তথ্য সবার কাছে থাকলে তাদের কিছু কিছু স্থানে প্রবেশ করতে দেয়া না-ও হতে পারে। এই ভয়ে তারা এখন ভ্যাকসিন পাসপোর্টের বিষয়টিকে নিয়ে বিতর্ক শুরু করছে। মাস্ক এবং টিকা নিয়ে যেমন অনেকেই রাজনীতি করছে, তেমনি এখন শুরু হয়েছে টিকার পাসপোর্ট নিয়ে।


আমেরিকার কিছু কিছু রাজ্য ঘোষণা দিয়েছে যে, কোনো দোকানপাট তাদের ক্রেতাদের কাছে টিকার পাসপোর্ট দেখতে চাইতে পারবে না। টিকা সে দিক বা না দিক, তার কেনাকাটা করার অধিকার ঠিকই থাকবে। এই অধিকার থেকে তাকে কেউ আটকাতে পারবে না।


তারা এটাও বলছে যে, যদি শপিংমলে, সিনেমায়, স্টেডিয়ামে এই পাসপোর্ট দেখতে চাওয়া হয়, তাহলে নতুন করে জটিলতা তৈরি করবে। দুটি ভিন্ন ক্লাস তৈরি হবে- একদিকে টিকা দেয়া মানুষ, আরেকদিকে টিকা ছাড়া মানুষ। এই ক্লাস তৈরি করা ঠিক হবে না বলেই মনে করে অনেক রাজ্য।


বিভিন্ন সরকার মনে করছে, এ ধরনের একটি টুলস দিয়ে মানুষের ভেতর ভেদাভেদ তৈরি করা ঠিক হবে না।


৪.


তবে কিছু কিছু সরকার এবং ব্যক্তি এর বিরোধিতা করলেও বিমানবন্দরে এর ভালো কিছু সুবিধা রয়েছে। যদি চট করেই জেনে ফেলা যায়, আপনি টিকা দিয়েছেন, তাহলে এয়ারলাইনসের পক্ষে আপনাকে ভেরিফাই করার সময় কম লাগবে- নইলে এই কাগজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্লেনে তুলতে সময় লাগবে। আপনার তথ্যটি ডিজিটাল অবস্থায় থাকলে পুরো প্রক্রিয়া খুবই দক্ষতাসম্পন্ন হবে।


আমেরিকার নিউইয়র্ক শহর এই টিকা পাসপোর্ট ব্যবহার করা শুরু করেছে। লুফথানসা ইতোমধ্যেই তাদের প্লেনে এটা পরীক্ষা করে। আমেরিকার জেটব্লু পরীক্ষামূলকভাবে স্থানীয়ভাবে শুরু করেছে।


পাশাপাশি অনেক দেশ বিমানবন্দরে আগত যাত্রীদের টিকা দেয়ার স্ট্যাটাস জানতে চায়। এবং ধীরে ধীরে এর প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। সে ক্ষেত্রে তারা যদি আন্তর্জাতিক ডেটাবেজ থেকে (কিংবা সেই দেশের ডেটাবেজকে বিশ্বাস করে) এ তথ্য পেয়ে যায়, তাহলে সেই দেশগুলোর জন্য ঝামেলা অনেক কমে গেল। যেমন আপনি যদি সিঙ্গাপুরে যান, তখন তারা আপনার চৌদ্দগোষ্ঠী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে। সে ক্ষেত্রে এই টিকা পাসপোর্ট একটি ভালো সমাধান হতে পারে।


তবে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিকার প্রমাণ দিতে হচ্ছে। তা না হলে কাউকে ক্লাসে যেতে দেয়া হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে এই টিকা পাসপোর্ট খুব ভালো কাজে লাগবে।


জীবন যেভাবে পাল্টে যাচ্ছে, তাতে সবার স্মার্টফোনে এই পাসপোর্টটি থাকতে পারে, যা আপনি পাবলিক প্লেসে গেলে কাজে লাগাবেন। যেমন খেলার মাঠ, সিনেমা দেখতে যাওয়া, শপিংমল কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে। এটা আপনার জীবনের অঙ্গ হয়ে যেতে পারে।


৫.


এই পাসপোর্ট বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতটা কাজে লাগবে, সেটা অবশ্য নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না। কারণ এখানে এখনো অসংখ্য মানুষ টিকা নেয়নি এবং তারা টিকা নেবে কি না, সেটা নিয়েও সংশয় রয়েছে। পাশপাশি এই বিশাল জনসংখ্যার দেশে কোথায় আপনি কাকে আটকাবেন? এই দেশে মানুষ নিয়ম মানতে রাজি নয়; এই দেশের মানুষ সুশৃঙ্খল নয়, এই দেশের মানুষ সামাজিকভাবে এখনো উন্নত নয়। তাদের বিশাল একটি অংশ এখনো কয়েক হাজার বছরের পুরোনো ধ্যান-ধারণায় আটকে আছে। এই দেশের মানুষ বিশ্বাস করে একটা, মুখে বলে আরেকটা, আর কাজে করে পুরো ভিন্ন আরেকটা। এমন জটিল একটি জাতিকে সবুজ পাসপোর্ট দিয়েই আটকে রাখা যাচ্ছে না, সেখানে আবার টিকার পাসপোর্ট!


ই-মেইল: [email protected]


লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও