করোনাভাইরাস: দক্ষিণ আফ্রিকার ভয়াবহ ধরন নিয়ন্ত্রণ হবে কিভাবে
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের যে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট বা ধরন ছড়িয়ে পড়েছে তা বেশ সংক্রামক এবং এর তীব্রতাও ভয়াবহ উল্লেখ করে উদ্বেগ জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এখনই ব্যবস্থা না নিলে সামনের দিনগুলোয় বাংলাদেশে শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকবে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, "নতুন এই ধরনটি যেহেতু দ্রুত ছড়ায় এখনই ব্যবস্থা না নিলে সামনের দিনগুলোতে সংক্রমণের সংখ্যাও বাড়বে, মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে যাবে।"
বাংলাদেশে করোনার দ. আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট প্রাধান্য বিস্তার করছে: আইসিডিডিআর,বি
বাংলাদেশে সম্প্রতি করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের বেশি সংক্রমণ হচ্ছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। সম্প্রতি আইসিডিডিআরবি’র এক গবেষণায় এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, গত ১৮ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে আইসিডিডিআরবি’র বিজ্ঞানীরা করোনা রোগীদের প্রায় ৫৭টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করেছেন। এর মধ্যে, ৪৬টি অর্থাৎ ৮০ শতাংশেরও বেশি দক্ষিণ আফ্রিকার করোনা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে।
দেশে করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় যে ঢেউ চলছে, সেটা লন্ডন ভ্যারিয়েন্ট (করোনার নতুন ধরন)। এ কারণে করোনা ভাইরাস দ্রুত ছড়াচ্ছে। অনেকে আক্রান্ত হলেও প্রথমে বুঝতে পারছে না। লাঞ্চ ইনফেকশন হওয়ার পর বুঝতে পারছে যে, করোনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার এটিই একমাত্র উপায়।
দেশে করোনার নতুন স্ট্রেইন ছড়িয়ে পড়া রোধে করণীয়
বাংলাদেশে বর্তমান সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির পেছনে যুক্তরাজ্যের ‘ইউকে স্ট্রেইন’ দায়ী কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও, বর্তমান সংক্রমণের গতি, বিস্তার, শনাক্তের হার, ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের সংখ্যার দ্রুত বাড়া, হাসপাতালের শয্যা কোভিড রোগীতে ভর্তি হয়ে যাওয়া, তরুণদের আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া— এসব কিছু মিলিয়ে এটি অনুমান করা যায় যে ইউকে স্ট্রেইনটি হয়তো দেশের জনগণের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলগুলোতে।
যদি এটি সত্য হয়, সরকারকে এখনই কঠোর ও কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে ‘স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করা যেতে পারে। এতে করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সকল স্তর সতর্কাবস্থায় থাকবে। স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা নিরসনে নিচে উল্লেখিত ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
১. দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন: যদিও সরকার এক সপ্তাহের জন্য দেশব্যাপী লকডাউন শুরু করেছে, তবে সম্ভবত এক সপ্তাহের লকডাউন সংক্রমণের বর্তমান ঊর্ধ্বগতি প্রশমনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। এ ধরনের সংক্রমণের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন সপ্তাহের লকডাউন প্রয়োজন। লকডাউন ছাড়াও সংক্রমণ কমাতে রাত্রিকালীন কারফিউ দেওয়া যেতে পারে। তবে, শুধু লকডাউন ঘোষণা করলেই কাজ হবে না। এর যথাযথ বাস্তবায়ন দরকার। প্রথম দিনের লকডাউন যেরকম ঢিলেঢালাভাবে হলো, এরকম চললে তিন মাস লকডাউন দিয়েও কাজ হবে না।
২. নিম্ন আয়ের মানুষকে সহায়তা: লকডাউনে দরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষেরা স্বভাবতই কাজ হারিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সময়টিতে কীভাবে তারা বেঁচে থাকবে এবং কীভাবে তারা তাদের পরিবারকে খাওয়াবে? সরকারের উচিত এই প্রথম সারির ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ রেশন ও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা। বিশৃঙ্খলা এড়াতে ও সমাজের প্রতিটি কোণ থেকে লকডাউনের সমর্থনের জন্য এই বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া একান্ত জরুরি।
৩. চিকিৎসা সহায়তা: ক্রমবর্ধমান কোভিড রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ঢাকাসহ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে ‘ফিল্ড হাসপাতাল’ স্থাপন করা উচিত। এ ছাড়াও সব কোভিড হাসপাতাল ও জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। অক্সিজেনের ব্যাপক চাহিদা মেটাতে কোভিড হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন জেনারেটর ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটর সরবরাহ করতে হবে।
৪. মিউটেশন সার্ভেইল্যান্স: দেশব্যাপী এখন মিউটেশন সার্ভেইল্যান্স শুরু করা জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি সব দেশকে ভ্যারিয়েন্ট সার্ভেইল্যান্স চালানোর আহ্বান জানিয়েছে। করোনা সংক্রমণ ও ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করার জন্য মিউটেশন সার্ভেইল্যান্স গুরুত্বপূর্ণ। জিনোম সিকোয়েন্সিং নতুন মিউটেশন শনাক্তকরণ ও মিউটেশন সার্ভেইল্যান্সের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি। তবে এই কৌশলটি ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ, যার জন্য দরকার বিশেষ দক্ষতা ও সক্ষমতা, যার অভাব স্পষ্টতই বাংলাদেশে রয়েছে।
বিকল্পভাবে থ্রি-জিন আরটি-পিসিআর কিট ব্যবহার করেও দেশে খুব সহজেই মিউটেশন সার্ভেইল্যান্স করা সম্ভব। এই পদ্ধতি ‘ইউকে স্ট্রেইন’ শনাক্তকরণে ৯৯ শতাংশ কার্যকরী। এই কিটটি ‘টেকপাথ কোভিড-১৯ কিট’ নামে পরিচিত। বিখ্যাত থার্মোফিশার কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে এই কিট উৎপাদন করেছে। এই নির্দিষ্ট কিটটি পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড (পিএইচই) তাদের তিনটি লাইটহাউজ ল্যাবরেটরিতে বি.১.১.৭ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তকরণের জন্য হাজারো নমুনায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। পরবর্তীতে এই কিটটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কমিউনিটিতে মিউটেশন সার্ভেইল্যান্সের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। পিএইচই প্রকাশিত ‘টেকনিক্যাল ব্রিফিং ২’ অনুসারে, থ্রি-জিন আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় এস-জিন ড্রপআউট ‘ইউকে স্ট্রেইন’ শনাক্তে একটি ভালো প্রক্সি হিসেবে কাজ করে।
৫. সেরোসার্ভেইল্যান্স: বাংলাদেশে মহামারির বয়স এক বছরেরও বেশি হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ছয় লাখের বেশি মানুষ। টিকাদান কর্মসূচি চলছে দেশজুড়ে। এখনই সেরোসার্ভেইল্যান্সের সঠিক সময়। অঞ্চলভিত্তিক ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেরোসার্ভেইল্যান্স না করলে হার্ড ইমিউনিটির দিকে দেশ কতটুকু এগোচ্ছে তা বোঝা যাবে না। এ ছাড়াও, ভ্যাকসিন আমাদের দেশে মানুষের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি করছে কি না, সেটা জানাও জরুরি। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে ৫৭ শতাংশ মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এই এন্টিবডি তৈরি হয়েছে করোনা সংক্রমণ ও টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যাকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হয়েছে। যুক্তরাজ্য কোভিডের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলার দিকে এগিয়ে চলেছে। হার্ড ইমিউনিটি গঠনে বাংলাদেশর অবস্থান কোথায়?