ইন্টারনেটের গতি ঠিক করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন!
অবস্থা যেটুকু বুঝতে পারলাম, শীঘ্রই বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গতি ঠিক হচ্ছে না। যদি আরো নির্মোহভাবে বলি, তা হলে এটা বললে খুব বেশি বলা হয়ে যাবে না যে, আমার জীবদ্দশায় এটা ঠিক হবে না। এখন যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে আগামী ১০ বছর পর যেখানে গিয়ে দাঁড়াবে, তত দিনে পৃথিবী আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তখনকার অ্যাপ্লিকেশনগুলো চালাতে আরো বেশি গতির প্রয়োজন হবে। ফলে এটা একটা ‘এলওয়েজ ক্যাচ-আপ’ গেম-এ পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে ফিক্সড ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কের বিস্তার ততটা নয়। তাই এটা নিয়ে কথা বলে কোনো লাভ নেই। যার অস্তিত্বই সামান্য, তার ভালোই কী, আর খারাপইবা কী! বাংলাদেশের ইন্টারনেটের অর্থ হলো মোবাইল ইন্টারনেট। মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। ছাত্রছাত্রীরা ডেটা প্যাক কিনে অনলাইন ক্লাস করে।
সম্প্রতি যে রিপোর্ট বের হয়েছে, তাতে বিশ্বের ১৩৮টি দেশের গতির মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩ (সূত্র: ওকলা গ্লোবাল স্পিড টেস্ট)। পৃথিবীর কথা যদি বাদ দিই, তা হলে দক্ষিণ এশিয়ার ভেতর আফগানিস্তান ছাড়া আর সবাই আমাদের থেকে ওপরে। আর পৃথিবীর কথা ধরলে উগান্ডা হলো আমাদের ওপরে!
ঘটনাটি এমন নয় যে, একটি রিপোর্ট বের হয়েছে বলেই বিষয়টি আমরা ধরতে পেরেছি। ইন্টারনেটের গতি নিয়ে বিগত বছরগুলোতে নানান মহলে কথা হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। যারা আশপাশের দেশগুলোতে ভ্রমণ করেন, তারা জানেন ভারতে অজপাড়াগাঁয়ে যে গতি পাওয়া যায়, থাইল্যান্ডের ছোট শহরগুলোতে যে গতি পাওয়া যায়, ইন্দোনেশিয়ার হাজার হাজার দ্বীপে যে গতি পাওয়া যায়, তার ছিটেফোঁটাও আমাদের জনগণ পায় না। ঢাকা শহরে গাড়িতে বসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সময় বুঝতে পারবেন মোবাইল ডেটার গতি কত প্রকার ও কী কী! হোয়াটসঅ্যাপ বা ভাইবারে কথা বলতে থাকলে সেটা কতবার ড্রপ হবে? আর ভিডিও থাকলে তো কথাই নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা কি এখনো গত শতাব্দীতে আটকে আছি? জীবন তো একটাই! এই একজীবনে ইন্টারনেটের গতি নিয়েই যদি যুদ্ধ করতে হয়, তা হলে এর ওপর নির্ভর করে যে সেবাগুলো তৈরি হবে, সেটা নিয়ে কাজ করব কখন?
কেন এই তথৈবচ অবস্থা?
বিষয়টি খুবই সহজ। মোবাইল ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনিয়োগ করেনি। আমাদের দেশে যত পরিমাণ গ্রাহক, তাদের ভালো সেবা দেয়ার জন্য আট লেনের রাস্তা তৈরি করার কথা, সেখানে তারা বানিয়ে রেখেছে এক লেনের রাস্তা। তাই ট্রাফিক জ্যাম তো হবেই।
আমরা সম্প্রতি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কুইজ- ১০০ দিনের ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কুইজ’ (১ ডিসেম্বর ২০২০-১০ মার্চ ২০২১) পরিচালনা করেছি। সেখানে প্রতি মঙ্গলবার রাতে ইন্টারনেটে লাইভ করেছি। সেই অনুষ্ঠানে ঢাকার বাইরে থেকে কোনো মানুষকেই আমরা একটা দিনও সুন্দরভাবে যুক্ত করতে পারিনি। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু থ্রি-জি আর ফোর-জির বিজ্ঞাপনে তো দেশ সয়লাব। তা হলে হচ্ছেটা কী?
এটা বোঝার জন্য কম্পিউটার বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। একজন সাধারণ ব্যবহারকারীও এটা বুঝতে পারেন। ঢাকা শহরের মানুষই যেখানে এত ভুক্তভোগী, সে ক্ষেত্রে ঢাকার বাইরের অবস্থা কতটা শোচনীয়। তারা ঢাকার বাইরে বিনিয়োগ করেনি বললেই চলে। শুধু নাম লেখানোর জন্য যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকুই করেছে।
অনেকেই হয়তো ভাবছেন, মোবাইল কোম্পানিগুলো নতুন করে তরঙ্গ কিনেছে। এখন সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিষয়টি কিন্তু ওই তরঙ্গে নয়। যেটুকু তরঙ্গ তাদের আছে, সেটাই তো ঠিকমতো ব্যবহার করেনি। দীর্ঘমেয়াদিতে তাদের ওই তরঙ্গ লাগবে। কিন্তু ঢাকা শহরে যে মানের ইন্টারনেট তারা দিচ্ছে, সেই মানের ইন্টারনেট অন্যান্য জেলা শহরে দিতে তো নতুন তরঙ্গ লাগে না।
মোবাইল কোম্পানিগুলোর দেশের মানুষ এবং লাইসেন্সের আওতায় যে সেবা এই দেশের মানুষকে দেয়ার কথা, সেটা না দিয়ে, অল্প বিনিয়োগে তারা মুনাফা মেক্সিমাইজ করছে। এটাই হলো মূল কথা। এটা লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ। আর এভাবে যদি সেবা দিয়ে মুনাফা বাড়ানো যায়, কেউ কিছু না বলে, তা হলে তারা এটা করবে না কেন? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তো সুযোগ পেয়ে পুরো দেশটাই নিয়ে নিয়েছিল। আর এটা তো মামুলি ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ!
দেখার কি কেউ নেই?
আছে, কিন্তু তারা পেরে উঠছে না। এটা প্রাথমিকভাবে দেখার দায়িত্ব হলো বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (সংক্ষেপে বিটিআরসি)। তারাই বাংলাদেশে যাবতীয় টেলিযোগাযোগব্যবস্থা, লাইসেন্স, সেবার মান, নিরাপত্তা ইত্যাদি দেখে রাখে। কিন্তু তারা মূলত তিনটি কারণে পেরে উঠছে না।
ক) বিটিআরসির পর্যাপ্ত টুলস নেই। এ ধরনের বিশাল একটি নেটওয়ার্ক দেখে রাখার জন্য যে ধরনের টুলস প্রয়োজন, সেগুলো বিটিআরসির কাছে নেই। তারা এত দিনেও সেগুলো কিনেনি। কিংবা কিনতে দেয়া হয়নি।
খ) বিটিআরসির পর্যাপ্ত লোকবল নেই। এ দেশে কয়েক হাজার লাইসেন্স অপারেট করা হয়। সেগুলোকে যদি দেখে রাখতে হয়, তা হলে যেসংখ্যক লোকবল দরকার এবং যে ধরনের মেধাসম্পন্ন লোক দরকার, সেটা বিটিআরসির নেই।
গ) তারপরেও যখন বিটিআরসি কিছু করতে যায়, মোবাইল কোম্পানিগুলো চট করে আদালতে গিয়ে মামলা করে বসে। দীর্ঘদিন ধরে চলে সেই মামলা। তাতে পুরো বিষয়টি ঝুলে যায়।
বিটিআরসির পরেও আরেকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেটা হলো বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। দেশের স্বার্থবিরোধী বিষয়গুলো তাদের দেখার কথা। কিছুদিন আগে আপনারা টেলিভিশনে কি দেখেছিলেন যে আমেরিকার সিনেট কীভাবে অ্যামাজন, গুগল, ফেসবুক এবং অ্যাপলের সিইওদের চেপে ধরেছিল? অনেককেই ওদিন পানির বোতল নিয়ে বসতে হয়েছিল। বাংলাদেশের সংসদীয় স্থায়ী কমিটিরও তেমন ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সেটা দেশের কল্যাণে ব্যবহার করলে তো ক্ষমতা!
একই কথা প্রযোজ্য বিটিআরসির জন্য। আমেরিকার এফসিসির সঙ্গে ওই দেশের টেলিকম কোম্পানিগুলো টালবাহানা করবে? চিন্তাই করা যায় না।
এখন একমাত্র উপায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ
অবস্থা যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, এখন উপায় একটাই। প্রধানমন্ত্রীকে এর ভেতর হস্তক্ষেপ করতে হবে। তিনি তো চান দেশ এগিয়ে যাক। তিনি চান এই দেশ সোনার বাংলা হোক, উন্নত দেশ হোক। বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেটের গতিকে ঠিক না করে উন্নত দেশ হওয়া যাবে না। উন্নত বিশ্ব একটি আপেক্ষিক বিষয়। এখন থেকে এক শ বছর আগের বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে এখনই আমরা উন্নত থাকতাম। কিন্তু যেহেতু অন্যান্য দেশ তাদের নাগরিকদের আরো বেশি কিছু দিতে পারছে, তাদের জীবনযাত্রার মান আমাদের থেকে অনেক বেশি ভালো, তাই ওটাই এখন মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদি এই মুজিব বর্ষের মধ্যেই কিছু ফলাফল আমরা পেতে চাই, তা হলে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নিচের পরামর্শগুলো সবিনয়ে দিয়ে রাখছি।
১) সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা। এখানে ভিন্ন কাউকে যুক্ত করলে সেটা আর হবে না। আমরা ইতোমধ্যেই সব দেখে ফেলেছি। প্রধানমন্ত্রীকেই থাকতে হবে।
২) সেই টাস্কফোর্সে সাতজন সদস্য থাকতে পারেন।
৩) টাস্কফোর্স এক মাসের মধ্যে এর করণীয় নির্ধারণ করবে। তারা বিটিআরসি, মোবাইল কোম্পানি, এনটিটিএন, ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বসে তিন দিনের একটি ওয়ার্কশপ করবে। সেখানেই সব তথ্য-উপাত্ত পেশ করা হবে।
৪) ওই ওয়ার্কশপে মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরবে।
৫) বিটিআরসি তার তথ্য-উপাত্ত এবং কোয়ালিটি অব সার্ভিসের রিপোর্ট জমা দেবে।
৬) ওই কমিটি দেশের বিভিন্ন স্থানে ড্রাইভ টেস্ট করবে, যার মাধ্যমে বুঝতে পারবে কোথায় ক্যাপাসিটি কেমন বসানো হয়েছে।
৭) যদি প্রতিষ্ঠানগুলো লাইসেন্সের শর্ত মোতাবেক নেটওয়ার্ক না বসিয়ে থাকে, তা হলে আইন অনুযায়ী জরিমানা করবে। পাশাপাশি এত দিন যে গ্রাহককে সেবা দেয়নি, তারও জরিমানা দিতে হবে।
৮) ভবিষ্যতে কত দিনের ভেতর এই নেটওয়ার্ক ঠিক হবে, তার দিন-তারিখ ঠিক করতে হবে এবং সেটা মনিটর করতে হবে।
৯) এই ইন্টারনেট ঠিক করার জন্য বাড়তি আরো কিছুর প্রয়োজন হলে (যেমন: এনটিটিএন ঠিক করা, ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য জেলার সংযোগ, ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক ইত্যাদি) এই কমিটি সেটাও নিশ্চিত করবে।
১০) এই টাস্কফোর্সের একটাই কাজ ইন্টারনেট ঠিক করা। একটার বেশি কাজ দিলে এরা কোনোটাই করতে পারবে না। তাই ফোকাস থাকাটা খুবই জরুরি।
বাংলাদেশের ইন্টারনেট এই মুজিব বর্ষের মধ্যেই ঠিক করতে হবে। এটাই হোক নতুন প্রজন্মের জন্য মুজিব বর্ষের সেরা উপহার। আশা করি, প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন।
শেষ কথা
প্রধানমন্ত্রীর একটি কথা দিয়ে লেখাটি শেষ করি। ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের অধিবেশন শেষে অধিবেশন কক্ষ থেকে বের হতে হতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সব নেতাকে কেনা যায়, এটাই সমস্যা। শেখ হাসিনা ছাড়া।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য সংসদের সাংবাদিক গ্যালারি থেকে শোনা যায়।
প্রধানমন্ত্রী বিনয়ী হয়ে শুধু নিজের দলের কথা বলেছেন। বাংলাদেশকে আমি যথেষ্টই দেখে ফেলেছি। বাংলাদেশে বাকিদেরও কেনা যায়, শুধু দামটা ভিন্ন। এটাই বাংলাদেশ। টেলিকম একটি বিশাল কেনাবেচার জায়গা। প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কারো পক্ষেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। আর কেউ পারলে আমাকে জানাবেন। তার পা ছুঁয়ে সালাম করে আসব, সত্যি!
ই-মেইল: [email protected]
লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ