ধীরগতির ইন্টারনেট পিছিয়ে দিচ্ছে দেশের উন্নয়ন

সারাক্ষণ জাকারিয়া স্বপন প্রকাশিত: ১৪ মার্চ ২০২১, ১১:৫০

বর্তমানে বাংলাদেশ তার জীবদ্দশায় সবচেয়ে ক্রিটিকাল সময় পার করছে। বাংলাদেশের জন্য এই দশকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে, আমাদের তরুণ নাগরিকদের কাছ থেকে যে সুবিধাটুকু আমরা পেতে পারি, তার শ্রেষ্ঠ সময় হলো এই দশক। আগামী দশকে সেটা ম্যাচুউর হবে। এবং চল্লিশের দশকে গিয়ে বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়াবে, সেটাই হবে পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশ। তারপর গ্রোথ খুব ধীরগতির হবে। এটা আমার একার কথা নয়, বাংলাদেশ নিয়ে যারা ভাবেন, তারাও এর সঙ্গে একমত।

এই দশকে এসে বাংলাদেশ যেমন তার ৫০ বছরে পা দিল, একইভাবে নতুন একটি দশক শুরু করেছে, যা তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেবে। এই দশকে যদি এই দেশ একই উন্নয়ন ধরে রাখতে না পারে, তাহলে আর হলো না। এই বিশাল জনসংখ্যার দেশটিকে উন্নত জীবনযাত্রার স্বাদ আর পাওয়া হবে না।

তবে এই দশকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইন্টারনেটের গতি। বাংলাদেশ যেভাবে তার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে, সেটা আরো বেশি বেগবান হতো যদি এই দেশের জনগণ পুরোপুরি ইন্টারেনেটের সুবিধাটুকু নিতে পারত। চলুন দেখে নিই, বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কোথায় কোথায় বড় আকারে ভুল করেছিল। তাহলেই বোঝা যাবে, এই দশকে আমরা সেটা কতটা করতে পারব।


নব্বইয়ের দশক

বাংলাদেশ মূলত তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রবেশ করে নব্বইয়ের দশকে। এর আগে বাংলাদেশ আইবিএম-এর মেইনফ্রেম কম্পিউটার ছিল। সেটা বিশেষ গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হতো। সাধারণ মানুষের, কিংবা সরকারের বড় কোনো কাজে সেগুলো ব্যবহৃত হতো না। তাই আমি শুরুটা করছি নব্বইয়ের দশক থেকেই।

এই দশকে এসে বাংলাদেশ তার প্রথম কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট বের করে। বুয়েটে তখন কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ানো শুরু হয়। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হয়। দেশে যথেষ্ট পরিমাণে লোকবল না থাকলে তো আর সেই ক্ষেত্রটি বেড়ে ওঠে না। সেই হিসেবে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে পা রাখতে শুরু করে।

সারা পৃথিবীতেও তখন পারসোনাল কম্পিউটারের ব্যবহার বাড়তে থাকে। বাংলাদেশেও তার ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। বাংলাদেশে তখন প্রথম কম্পিউটার কাউন্সিল গঠিত হয়। তারাই মূলত বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে চালিত করত। বাংলাদেশে তখন দুটি বিষয় ঘটল: ক) অনলাইন ইন্টারনেট প্রবর্তন, খ) মিলিনিয়াম (১৯৯৯ সাল থেকে ২০০০ সালে প্রবেশ)।

তখন খুব স্বল্পমাত্রায় বাংলাদেশের মানুষ চড়া দামে ইন্টারনেট পেতে শুরু করল। পাশাপাশি পুরো পৃথিবীতে ডেটা এন্ট্রি করার বিশাল একটি বাজার তৈরি হলো, যা ভারত নিয়ে নিল। বাংলাদেশ ওই বাজারে প্রবেশ করতে পারল না। এর মূল কারণ ছিল, বাংলাদেশ তখনো ওই বাজার ধরার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ভারত আশির দশকেই যেভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল, সেটা বাংলাদেশ পারেনি। ফলে বিলিয়ন ডলারের পুরো ব্যবসাটাই চলে যায় ভারতে।

ওই দশকে বাংলাদেশ বিনা মূল্য সাবমেরিন কেবলে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল, যা তখন এই দেশ নেয়নি। ফলে বাংলাদেশ নিজেকে আরো পিছিয়ে দিল। গত শতকে বাংলাদেশ যা পেতে পারত, সেটা আর হলো না। ওই সুযোগটুকু ধরতে পারলে পরবর্তী দশকগুলো আরো ভালো হতো।

আমাদের নেতৃত্বের ভিশনটুকু তখনো গ্লোবাল মার্কেটের জন্য প্রস্তুত ছিল না।


এই শতাব্দীর প্রথম দশক

এই দশকে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার কিছুটা বেড়েছিল। পুরো বিশ্বেই তখন ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। এবং ইন্টারনেটের উত্থান ওই সময়টাতেই। সিসকোর মতো বিশাল প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল শুধু ইন্টারনেটের গ্রোথকে সামনে রেখে। ওই প্রতিষ্ঠানটি তখনই ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

এই দশকের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি ছিল ভয়েস অভার আইপি (ভিওআইপি)। পুরো বিশ্ব যখন এই প্রযুক্তিকে বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ এই প্রযুক্তিকে নিষিদ্ধ করে দিল। তারা মনে করল, এর ফলে আন্তর্জাতিক ভয়েস কলের মুনাফা কমে যাবে। দেশের ভেতরেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। ফলে এই প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ যুক্ত হলো না। দেশের মানুষকেও যুক্ত করল না।

ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এই প্রযুক্তিকে কাছে টেনে নিল। ইউরোপের একটি ছোট দেশ এস্টোনিয়ার চারজন প্রোগ্রামার তৈরি করে ফেলল স্কাইপ। এই উদাহরণটুকু এ জন্য দিলাম যে, প্রযুক্তিকে উন্মুক্ত রাখলে মানুষ কতটা ক্রিয়েটিভ হতে পারে, মানুষ কতটা জ্ঞানের দিক থেকে এগিয়ে যেতে পারে, সেটা বোঝানোর জন্য। সেই স্কাইপ আমরা এখনো ব্যবহার করছি। স্কাইপ হলো একটি উদাহরণ মাত্র। কিন্তু স্কাইপের মতো এমন অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল, যেগুলো পরবর্তী সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশাল অবদান রেখেছে।

বিশ্বের অনেক দেশ তার জনসংখ্যাকে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করে ফেলেছিল, যার সুবিধা তারা এখনো পাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেটা পারেনি। সে আটকে গিয়েছিল তথ্যপ্রযুক্তিকে বাধা দিতে, মানুষকে যুক্ত করতে পারেনি। একটি জাতিকে কীভাবে প্রস্তুত করতে হয়, সেটা বুঝতে পারেনি। তারা ব্যস্ত হয়ে গেল চোর-পুলিশ খেলায়। ওই প্রযুক্তি উন্মুক্ত করে রাখলে বাংলাদেশের জনগণ এখন অনেক বেশি প্রস্তুত থাকত।


এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক

খুব নির্মোহভাবে যদি বলি, তাহলে গত দশক থেকেই আসলে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করেছে। সরকার তার অনেক সেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি এ খাতটি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

গত দশকের শুরুতে ইন্টারনেটের ব্যবহার যতটা ছিল, সেটা অনেকাংশে বেড়েছে দশকটির শেষ ভাগে এসে। তবে বাংলাদেশ এই ব্যবহারকারী আগের দশকেই পেতে পারত, যদি সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারত।

এই দশকে বাংলাদেশের মানুষ প্রাইভেট সেক্টরেও সেবা পেতে শুরু করেছে। ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা, ডিজিটাল পেমেন্ট, ই-কমার্সগুলো আসতে শুরু করে, যেগুলো পৃথিবীর অনেক দেশ আরো ২০ বছর আগেই করে ফেলেছে। অর্থাৎ আমরা অন্তত ২০ বছরে পিছিয়ে থাকলাম।

আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা নিজেদের চেষ্টায় ফ্রিল্যান্সিং কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাংলাদেশে বসে বিশ্বের উন্নত দেশের কাজ করতে শুরু করে। তবে বিদেশ থেকে টাকা আনা নিয়ে হাজারো ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল, যেগুলো এখন অনেকটাই ঠিক হয়ে এসেছে। কিন্তু এগুলোও আরো ১০ বছর আগেই ঠিক হয়ে যেতে পারত। শুধু নীতিগত কারণে পিছিয়ে যাওয়া। তারপরেও বলব, বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিং ক্ষেত্রে বেশ ভালো একটি জায়গা করে নিয়েছে। এই কাজটিতে বাংলাদেশ আরো ভালো করতে পারত যদি সে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটের ভালো গতি পৌঁছে দিতে এবং ডিজিটাল পেমেন্টটাকে সহজতর করতে পারত।


এই শতাব্দীর তৃতীয় দশক

এই দশকটি কেবল শুরু হয়েছে এবং এই দশকে আমরা যা করব, তার অনেক কিছুর ফল পাব আগামী দশকে গিয়ে। কিন্তু এই দশকে কাজটি না করলে সেটা আগামী দশকেও পাব না। কোনো কিছুই এমন নয় যে, একটা বোতাম চেপে দিয়ে তাড়াতাড়ি করে ফেলা যাবে। এগুলো করতে সময় লাগে এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়।

যে কাজটি আরো দুই দশক আগেই হতে পারত, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। সেটা হলো ইন্টারনেটের গতি, উন্নত মানের ইন্টারনেট। বাংলাদেশ এটাকে যদি ঠিক করতে পারত, তাহলে তার জিডিপি আরো ২ ভাগ বেড়ে যেত। কিন্তু আমরা এখনো সেখানে স্ট্রাগল করছি।

বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গতি যে উগান্ডার চেয়েও খারাপ, সেটা গত সপ্তাহের একটি রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে। অবস্থাটা নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন। বাংলাদেশের মানুষ দুই উপায়ে ইন্টারনেট পেয়ে থাকে। একটি হলো ফাইবার অপটিক ব্রডব্যান্ড, আরেকটি হলো মোবাইল ইন্টারনেট। বাংলাদেশে পরিকল্পিত উপায়ে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেনি। ঢাকার চেয়ে জেলা শহরগুলোতে ইন্টারনেটের গতি এবং মূল্য বেশি। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখনো ঢাকাকেন্দ্রিক, যা মোটেও কাম্য নয়। ঢাকায় কিছু কিছু এলাকা ফাইবারের আওতায় এসেছে। কিন্তু সেগুলো আন্তর্জাতিক মানের নয়। আর এটাই যেহেতু মূল রাস্তা, সেই রাস্তাটুকু ভালো না হলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে এখন।

আর মোবাইল ইন্টারনেটের অবস্থা যে ভয়াবহ খারাপ, সেটা তো আমরা সবাই জানি। ঢাকা শহরের মানুষ কিছুটা ফোর-জির গতি পেলেও ঢাকার বাইরের অবস্থা খুবই নাজুক। এটা একটি ভিডিও কল করলেই বুঝতে পারবেন। এটা বোঝার জন্য কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ার প্রয়োজন নেই। এটা মূলত হয়েছে মোবাইল অপারেটররা ঢাকার বাইরে তেমন বিনিয়োগ করেনি, যা তাদের লাইসেন্সের আওতায় করার কথা। এবং বাংলাদেশ যেহেতু এটাকে নিশ্চিত করতে পারেনি, তাই দেশ আরো ১০ বছরের বেশি সময় পিছিয়ে গেল। ভারতের একটি অজপাড়াগাঁয়ে বসে মানুষ যেভাবে লাইভ করতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ সেটা জেলা শহরেই পারে না। তাহলে কোন দেশটি এগোবে?

এই দশকের বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সামনে তিনটি চ্যালেঞ্জ। প্রথমটি হলো, উন্নত মানের ইন্টারনেট, যা আরো ২০ বছর আগেই সমাধান হওয়ার দরকার ছিল। দ্বিতীয়টি হলো উন্নত বুদ্ধির মানুষ। তথ্যপ্রযুক্তি হলো এমন একটি খাত, যেখানে বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। ফ্যাশন শো করে এ সমস্যার সমাধান হয় না। এর জন্য চাই প্রকৃত বুদ্ধিমান মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের ব্রেইন-ড্রেইনের ভেতর পড়ে গেছে। পৃথিবীর বড় বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ভালো লোকগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে সেবা তৈরি করার মতো মানুষ এ দেশে থাকছে না। আমরা মূলত কনজ্যুমার হচ্ছি। আমাদের যদি প্রস্তুতকারকের ভূমিকায় আসতে হয়, তাহলে আরো ব্রেইন লাগবে। প্রয়োজন যারা বিদেশে চলে গেছেন, তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে, যা মালয়েশিয়ার মাহাথির করেছিলেন। আর তৃতীয়টি হলো, ইন্টিলেকচুয়াল প্রোপার্টির কপিরাইট প্রটেকশন, যাতে বাংলাদেশ এখনো বেশ দুর্বল। মেধাস্বত্ব যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না যায়, তাহলে মেধাবীরা ওখানে থাকবে না। আর এই শিল্পে মেধার কোনো বিকল্প নেই।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ ভালো করবে। কিন্তু বারবার ভুল করলে সেই ভুলের মাশুল দিতে দিতেই একটি জাতি পিছিয়ে পড়ে। আমরা অন্যান্য খাতে যেমন ভালো করছি, তেমন এই খাতটিকে যদি আরো ভালো করতে হয়, এর থেকে পুরো সুবিধা নিতে হয়, তাহলে ওপরের তিনটি বিষয়কে শক্তভাবে ধরতে হবে। তখন ফলাফল না পাওয়ার তো কোনো কারণ আমি দেখি না। এ দেশ ভালো করবেই।

ঢাকা, ১৩ মার্চ, ২০২১

ই-মেইল: [email protected]

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও