কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

আমারও একটি নদী ছিল!

সারাক্ষণ জাকারিয়া স্বপন প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১২:১৮

জাকারিয়া স্বপন

আই এম ব্লিডিং ইনসাইড!
সত্যি আমার ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে, যা আমি কাউকে বোঝাতে পারব কি না জানি না! অনেক দিন এভাবে এতটা খারাপ লাগেনি! কাল একুশে ফেব্রুয়ারি। ভেবেছিলাম স্বাধীনতার পর এই পর্যন্ত বাংলা ভাষা কতটা এগোলো- সেটা নিয়ে লিখব। কিন্তু গতকাল সারাটা দিন আমি যার ভেতর দিয়ে গিয়েছি, সেটা লিখে না রাখলে নিজেকে ঠকানো হবে। তাই দিনের শেষে রাত জেগে লিখতে বসা।

এক.
অনেক বছর পর ময়মনসিংহ শহরে রাত যাপন করছি। ভোরে ঘুম ভেঙে থানার ঘাটে গিয়েছি ব্রহ্মপুত্রকে আরেকটু ভালো করে দেখব বলে। থানার ঠিক সামনে দিয়েই ছোট একটি গলি প্রবেশ করেছে নদের দিকে। মানুষ সেই ভোরেই নৌকায় করে নদটি পার হয়ে, তারপর হেঁটে শহরে ঢুকছে। থানার উল্টো দিক দিয়ে যেই না আমি নদের পাড়ে গিয়েছি, মুহূর্তেই বুকটা আমার ধক করে উঠল। নদ কই?! পানি কই?
ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকে- প্রাইমারি স্কুল থেকে। আমার মামাবাড়ি হলো নান্দাইল। ময়মনসিংহ শহর থেকে নান্দাইল যেতে এই নদটি পার হতে হতো। তখন দুটো অপশন ছিল। স্টিমারে করে পার হওয়া (যেটাকে বলা হতো ফেরি), নয়তো নৌকা করে। ফেরি পেতে সময় বেশি লাগত বলে আম্মা আমাদের নিয়ে নৌকায় পার হতেন। ওপারে শম্ভুগঞ্জ। সেখান থেকে বাসে করে নান্দাইল।
ব্রহ্মপুত্র পার হতে তখন প্রায় ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টাও লেগে যেত। একটা নৌকায় ২০-৩০ জন মানুষ। পুরো নদটি থই থই করছে। এপার থেকে ওপার দেখা যেত না। মাঝনদ নৌকার দোলনা। আম্মা আমাদের ধরে রাখতেন। খুব ভয়ে ভয়ে পার হতাম সেই নদ। শম্ভুগঞ্জ নেমে আমরা লম্বা দম নিতাম। জীবন নিয়ে নদ পার হতে পেরেছি- বিশাল স্বস্তি। তারপর অনেকটা হেঁটে মূল রাস্তায় উঠতে হতো বাস ধরার জন্য। এই নদ পার হতে হবে দেখে আমরা মামাবাড়ি যেতে চাইতাম না, ভয়ে। আজ ৪০ বছর পর নদটি হারিয়ে গেল! হেঁটে পার হচ্ছে মানুষ!
হঠাৎ করেই প্রিয় মানুষের মৃত্যু সংবাদে যেমন হয়, আমারও হয়েছে সেই অবস্থা। আমি পাগলের মতো খুঁজতে থাকি নদটিকে। কোথা দিয়ে আমরা নৌকায় উঠতাম, আর কোথায় গিয়ে নামতাম! সেই প্রমত্তা বিশাল নদটির বুকে এখন শুধুই আবর্জনা। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। চোখে পানি চলে এল। সেই পানি আড়াল করতে আমি নদটির দিকে হাঁটতে থাকি- যেই পথে মানুষ ওপার থেকে এই পাড়ে শহরে আসছে। আর আমি যাচ্ছি উল্টো পথে। কিছুটা হেঁটে নদটির পানির কাছে গেলাম, যেখানে মাত্র কয়েক শ ফুট খালের মতো একটু পানি আটকে আছে। ওটাই মানুষ আর গরু পার করছে।
ওখানে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম, কী বিশাল আয়তন ছিল নদটির। কারণ, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে তা থেকে অনেক অনেক উঁচু হলো নদটির পাড়। নদটির দুই পাশ শহরের যাবতীয় নোংরায় ভরা। নোংরায় ভরা সেই বালুর ওপর দিয়ে নানান বয়সের মানুষ শহরে আসছে- শিশু, নারী, বৃদ্ধ। তারা হয়তো জানেও না, কী ভয়ংকর নদ ছিল এই ব্রহ্মপুত্র! আমার চোখ আবারও ভার হয়ে এল।

দুই.
ময়মনসিংহ জিলা স্কুল তার ৩৬টি ব্যাচের ছাত্রদের মাঝে ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে। ১৯৭১ সালে ব্যাচ যেমন রয়েছে, আবার সম্প্রতি পাস করেছে, তেমন ব্যাচও রয়েছে। মূলত এই আয়োজন দেখার জন্যই ময়মনসিংহ আসা।
চমৎকার খেলার আয়োজন করা হয়েছে স্কুলের মূল মাঠে এবং হোস্টেলের মাঠে। হালকা শীতের এই সময়টাতে ফ্লাডলাইটে খেলার ব্যবস্থা। খুবই সুন্দর আয়োজন। হাজার হাজার মানুষ এসেছে এই উৎসব দেখার জন্য। ময়মনসিংহের এমনিতেই ক্রিকেটের সুনাম রয়েছে। সার্কিট হাউস মাঠে গেলেই দেখা যাবে ক্রিকেট নিয়ে কী ভীষণ ব্যস্ততা। আমাদের প্রথম খেলা দুপুরে জিলা স্কুল হোস্টেলের মাঠে। চারপাশ এমন সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, এই করোনার সময়েও বেশ উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা।
হোস্টেলের গেট পার হতেই আমি বুঝতে পারি, এই হোস্টেলটি আর বাসযোগ্য নেই, পতিত হয়েছে। দালানগুলো এমনি দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছু ভেঙে পড়ছে। ময়লার স্তূপ চারদিকে। আমি দ্রুত হেঁটে চলে গেলাম হোস্টেলের পেছনে পুকুরে- যেখানে দিনের পর দিন সাঁতার কেটেছি।
পুকুরঘাটে গিয়ে আমি থ! এটা তো পুকুর নয়, যেন একটা নোংরা ডোবা। গোসল করার তো প্রশ্নই ওঠে না, পা ভেজানোর মতো অবস্থাও নেই। স্নিগ্ধ সেই পুকুরঘাট এখন নর্দমার ভাগাড়। টলমল করা সেই পুকুরের পানি কোথায় গেল! এটাকে কে ডাস্টবিন বানাল!
সকালে ব্রহ্মপুত্র আমার গালে কষে যে চড়টা বসিয়েছিল, এখন অপর গালে থাপ্পড় মারল জিলা স্কুলের হোস্টেলের পুকুর! এটারও মৃত্যু হয়েছে!
আমি কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছিলাম না। কোনো রকমে একটা খেলা দেখে বন্ধুদের বললাম, ‘চল নদের পাড়ে পার্কে যাই। কে কে যাবি, চল।’ বলতেই অনেকে রাজি হয়ে গেল। আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম, মৃত্যু কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে!

তিন.
শিল্পী জয়নুল আবেদিনের যে আর্ট গ্যালারিটা আছে, ওটার সামনের নদটির অংশ ছিল আমাদের দখলে। দখল শব্দটা বলছি এই কারণে যে, ওটা সত্যি সত্যি আমাদের দখলে ছিল। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ছিল। এবং সেই জায়গায় অন্যরা বসত না। আরো খোলাখুলি যদি বলি, পুরো এলাকাটার রাজত্ব ছিল আমাদের হাতে। বিকেল থেকে রাত অবধি- আমরাই মাতিয়ে রাখতাম সেই নদের পাড়।
আমাদের ১৫-২০টা সাইকেল ছিল। কখনো তার চেয়েও বেশি। লাইন দিয়ে সাইকেলগুলো দাঁড়িয়ে থাকত। আমরা পানির ওপর ঢেউ গুনতাম। চাঁদনী রাতে পানি, চিকচিক করা বালু আর পাতার ছায়ার সঙ্গে খেলা করতাম। ওই চাঁদের আলোতে কীভাবে ছবি তুলতে হয়, সেই পরীক্ষা করতাম- নয়তো বালুর নিচে পা ডুবিয়ে এমনি এমনি বসে থাকতাম।
আমাদের এতগুলো বন্ধু একসঙ্গে ওই পার্কটি দখল করে রাখত যে, অন্যরা খুব একটা এসে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত না। মোটামুটি সবাই জানত, ওটাই আমাদের গন্তব্যস্থল।
ছোটবেলায় যে ব্রহ্মপুত্র পার হতে ঘণ্টাখানেক লেগে যেত, সেই নদে হালকা চর পড়তে দেখলাম আমার যৌবনে। আমাদের চোখের সামনেই চরটি ধীরে ধীরে বুক ফুলিয়ে দিল। আমরা দেখলাম, নদটি দুই ভাগ হয়ে গেল। দুটো ধারা তৈরি হতে থাকল।
সকালে গিয়েছিলাম এক প্রান্তে। আর বিকেলে গেলাম আরেক প্রান্তে- যেখানে আমার যৌবন কেটেছে। আমাকে সবাই নিশ্চিত করল যে, ওই যে ধু ধু করছে গাছের সারি, ওটাই ছিল নদটির ওপার। সেখান থেকে এখন নদটি হয়েছে কয়েক ফুট। গভীরতাও কয়েক ফুট। নৌকার লগি দেখলেই সেটা বোঝা যাচ্ছে।
মরা নদে আমরা নৌকায় উঠি। মাঝি আমাদের ওপারে নামিয়ে দেয়, যা ছিল আমাদের সেই চরটি। এখন নদটি ওখানেই এসে ঠেকেছে। তবে পানি নেই বললেই চলে। এটাকে এখন খাল বলতেও আমার কষ্ট হচ্ছে।
এখানে যে একটি উত্তাল নদ ছিল, সেটা এখন আর কাউকেই বোঝানো যাবে না। এখন থেকে আরো ২০ বছর পর এখানে অবশিষ্ট কিছু থাকবে বলে মনে হয় না।

চার.
ব্রহ্মপুত্রের মৃত্যু আমাদের সহপাঠীরা কেউ মেনে নিতে পারছিলাম না। আমরা দ্রুত আবার জিলা স্কুলে ফেরার তাগিদ অনুভব করলাম। কোনোরকমে গাড়িতে উঠে এবার চলে এলাম জিলা স্কুলের মূল ক্যাম্পাসে, যেখানে আমাদের ক্লাস হতো।
স্রষ্টা আমাকে এই কষ্টটুকু দেয়ার জন্য এখনো বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এই করুণ স্কুলটিতে আমরা পড়িনি- সে আমাদের সব সহপাঠী স্বীকার করল। এ কী করুণ হাল হয়েছে ১৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠটির!
আমি প্রায় দৌড়ে গেলাম স্কুলটির পেছনের পুকুরটি দেখতে। ওই পুকুরে এই অঞ্চলের সাঁতার প্রতিযোগিতা হতো। টলমল পানিতে আমরা নিজেদের মুখ দেখতাম। ওই পুকুরে নামতে আমরা ভয় পেতাম- যদি এটুকু নষ্ট করে ফেলি!
ওটাও এখন ডোবা, ময়লা নর্দমা। মায়াবি সেই পুকুরটির মৃত্যু হয়েছে। ভবনগুলো ভেঙে পড়ছে। কোথাও কোনো মেইনটেন্যান্সের ছিটেফোঁটা নেই। এমনভাবে চারদিকে গ্রিলের বেড়া দেয়া হয়েছে যেন এটা বিদ্যানিকেতন নয়, একটা কয়েদখানা।
আমার চোখে আবারও পানি চলে এল। দ্রুত এলাকা ত্যাগ করলাম। সঙ্গে কয়েকজন সহপাঠী বলে উঠল, এই দৃশ্য দেখাটা ঠিক হলো না। স্কুলের সুখের স্মৃতিটুকু নষ্ট হয়ে গেল!
সব সময় পুরোনো জায়গায় যেতে নেই!

পাঁচ.
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের যেমন উন্নয়ন হয়েছে, সেই ছোঁয়া ময়মনসিংহেও লেগেছে। জিলা স্কুলকে ঘিরে চারপাশে যে বিশাল উঁচু ভবনগুলো তৈরি হয়েছে, সেই ধাক্কায় জিলা স্কুল তার উজ্জ্বলতা এবং জৌলুশ হারিয়েছে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, আগামী ২০ বছরের ভেতর জিলা স্কুলকে একই জায়গায় রেখে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো যাবে না। হয়তো এটাকে এই জায়গা থেকে সরাতে হবে। নইলে অন্য জায়গায় নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি হবে। আর যদি এখানেই থাকে, তাহলে এটা হয়তো ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই দাঁড়িয়ে থাকবে।
একইভাবে ময়মনসিংহ শহরের অন্য বিদ্যাপীঠগুলোর দীনতাও চোখে পড়ল। বিদ্যাময়ী স্কুল, সিটি স্কুল, মুসলিস গার্লস স্কুল/কলেজ, মমিনুন্নেসা কলেজ, আনন্দ মোহন কলেজ- সবকিছুতেই মেইনটেন্যান্সের বড়ই অভাব। ভবনের ইট খুলে পড়ছে, দরজা-জানালাও ঠিক নেই। এর ভেতরই এই অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হবে। আশপাশের এলাকাগুলো থেকে লাখ লাখ মানুষ এই শহরের ওপর হামলে পড়েছে যেন!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো ঠিক করে ফেলা যাবে! কিন্তু মরে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র? এটাকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। কেউ কি একবার ভেবে দেখেছেন, এই নদটি যদি সেই প্রবহমান থাকত, তাহলে কত সুন্দর হতো এই শহরের জীবনযাপন?
আমরা কোনোভাবেই নদটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। একটা সময় ছিল, বাংলাদেশকে নদ-নদীর দেশ বলা হতো। এখন আর সেটা বলা যাবে না। ভূপেন হাজারিকা গণমানুষের কথা বলতে নদীদের অভিমান করে গেয়েছিলেন, ‘বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের-/হাহাকার শুনেও,/নিঃশব্দে নীরবে- ও গঙ্গা তুমি-/গঙ্গা বইছ কেন?’
তিনি বেঁচে থাকলে এখন হয়তো ওই গান আর লিখতেন না, গাইতেন না। কারণ গঙ্গারা এখন আর বইছে না। বিস্তীর্ণ দুই পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার নদীরা শুনতে পেয়েছে।


ইমেইল: [email protected]
ময়মনসিংহ, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও