মেধা দরকার হয় কেন!
ধরুন একটি সভাকক্ষে ১০ জন মানুষ বসে আছেন। বাংলাদেশের যেকোনো একটি জেলা কিংবা উপজেলার ১০ জন বিভিন্ন পেশার মানুষ। আচ্ছা ধরলাম ময়মনসিংহ শহরের মানুষ তারা। তাদের আমি বললাম, ‘আগামী বছর থেকে কোনো স্কুলের কোনো সিলেবাস থাকবে না। ছেলেমেয়েরা যে যার মতো স্কুলে যাবে। শিক্ষক তার খুশিমতো কিছু একটা শেখাবেন। ছাত্রছাত্রীরা আনন্দের সঙ্গে স্কুলটা উপভোগ করুক।’
আমার এমন প্রস্তাবে তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? কেউ কি আমার সঙ্গে এগিয়ে আসবে? নাকি ওই ১০ জনের সবাই আমাকে পাগল মনে করে সভাকক্ষ থেকে বের হয়ে যাবে?
এবার ধরুন, একই প্রস্তাব আমি করলাম ঢাকার ১০ জন বিশেষ শিক্ষাবিদের সামনে, একই রকম একটি সভাকক্ষে। তারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন? এই ১০ জনের ভেতর কতজনকে আমি সঙ্গে পাব? ১ জন, নয়তো ২ জন!
এবারে একই আইডিয়া আমি ইউরোপের কোনো একটি দেশের (জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, ফ্রান্স ইত্যাদি) ১০ জন মানুষের সামনে যদি প্রস্তাব করি তখন কী হবে? আমি ঢাকায় যা সমর্থন পেয়েছিলাম তার থেকে অনেক বেশি সমর্থন পাব। এরপর যদি আমি একই জিনিস সিলিকন ভ্যালিতে গিয়ে বলি, ১০ জনের ভেতর হয়তো ৯ জনই বলবে, তাই নাকি! কীভাবে কী করবে বলো তো?
এরা কেউই মুহূর্তেই কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। আমার পুরো প্রস্তাবটি শুনবে। বিভিন্নভাবে বাছ-বিচার করবে। তারপর যদি দেখে এর থেকে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে, তখন বলবে আচ্ছা ছোট একটা পাইলট প্রজেক্ট করে ফেল। তারপর দেখা যাক, কী দাঁড়ায়! পাইলট প্রজেক্টে ভুল থাকলে, সেটাকে ঠিক করবে। কোনো নতুন আইডিয়া মুহূর্তের মধ্যেই ‘নাকচ’ করে দেবে না।
সামাজিক পরিবর্তন একা একা হয় না। সমাজ তৈরি হয় মানুষ নিয়ে। সমাজ পরিবর্তনে মানুষকে অংশগ্রহণ করতে হয়। একা একা শুরুটা করা যায়, বেশি দূর নেয়া যায়। সমাজে এমন মেধাবী মানুষ থাকতে হয়, যারা বিষয়টা ধরতে পারবে। এবং সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থন দেবে। যেই সমাজে সেই মেধাটুকু থাকবে না, তারা আবল-তাবল বকবে; কারণ বিষয়টি বোঝার মতো যোগ্যতা তার এখনো তৈরি হয়নি।
এটাকে বলে সামষ্টিক বুদ্ধিমত্তা। ধরুন, একটি বিশাল টেবিলের একদিকে ১,০০০ জন জার্মান মানুষ বসে আছেন, আরেকদিকে আমাদের ১,০০০ জন বসে আছেন। সবাই যার যার দেশের সবচেয়ে মেধাবী মানুষ। টেবিলের কোন দিকের মানুষের সম্মিলিত মেধা বেশি?
দুই.
বিগত ৫০০ বছরে এই বাংলাদেশ এবং বিশ্ব কীভাবে পাল্টেছে- এটা আমার লেখাপড়ার বর্তমান বিষয়। সে জন্য আগের দুটো লেখায় বলেছিলাম- বাংলাদেশ মেধা হারাচ্ছে, এবং বাংলাদেশের হাতে আর সময় আছে মাত্র ২০ বছর। বিগত ২০০ বছরে পৃথিবীতে যে পরিবর্তন হয়েছে, আগামী ২০ বছরে পৃথিবীতে তার চেয়ে বেশি পরিবর্তন হবে। সেটা বোঝানোর চেষ্টা করছি। দেখি কতটা পারা যায়!
বলেছিলাম, এখন থেকে মাত্র ৪৭৭ বছর আগে নিকোলাস কুপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) সবাইকে জানিয়েছিলেন, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না, বরং সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে। এখন থেকে ৫০০ বছর আগে পৃথিবীতে ছিল অটোম্যানদের সাম্রাজ্য- যারা কিনা মাত্র আড়াই কোটি মানুষকে শাসন করত। তখন এই গ্রহের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ কোটি।
বিগত সময়টাতে কারা শাসন করেছে এই বাংলা?
মূলত সুলতানদের হাত ধরে এই বঙ্গ পরিচালিত হয়েছে তখন। আমি হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসে গেলাম না। পনেরো শতকের শুরুতে এই মাটি শাসন করেছে হোসাইন শাহী (১৪৯৪-১৫৩৮)। তারপর এই মাটিতে আসে শের শাহ সুরির হাত ধরে সুরি সাম্রাজ্য (১৫৩২-১৫৫৬)। তারপর দীর্ঘ সময় শাসন করে মোগলরা (১৫৬৫-১৭১৭), যার গোড়াপত্তন হয় আকবরের হাত ধরে। সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহ জাহান এবং আওরঙ্গজেব- এগুলো হয়তো অনেকেই জানেন। তাদের অধীনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সুবেদার। তারাই ‘বাংলা সুবাহ’-কে শাসন করেছে।
তারপর বাংলা শাসন করেছে নবাবরা। বাংলার প্রথম নবাব ছিলেন মুর্শিদ কুলি খান, যিনি ১৭১৭ থেকে ১৭২৭ প্রায় ১০ বছর এই বাংলা শাসন করেন। আর বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন আলি বর্দি খানের দৌহিত্র নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহ, যিনি মাত্র ২৩ বছর বয়সে নবাব হয়েছিলেন। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলা তার স্বাধীনতা হারায়। বাংলা চলে যায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে।
ব্রিটিশরা এই দেশ শাসন করে প্রায় ২০০ বছর। ব্রিটিশদের আনুগত্যে অসংখ্য নবাব তারপর বাংলা শাসন করেছে। ১৯৪৭ সালে (মাত্র ৭৩ বছর আগে) তারা এই দেশ ছেড়ে চলে যায়। ব্রিটিশদের শাসন দেখেছেন এমন মানুষ এখনো অনেকেই বেঁচে আছেন। ব্রিটিশরা ১৯৩৭ সালে প্রভিন্সিয়াল পদ্ধতি চালু করলে, বাংলা থেকে ১৯৩৭ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক। তারপর খাজা নাজিমুদ্দিন ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৪৭ সালে ভারত দুই ভাগ হয়ে গেলে বাংলাও দুই ভাগ হয়ে যায়। তবে বাংলা যে এবারেই দুই ভাগ হলো, তা নয়। আগেও বাংলা ভাগ হয়েছে, আবার জোড়া লেগেছে। এবার পূর্ব বাংলার ক্ষমতা চলে যায় পাকিস্তানের হাতে।
তারপর দীর্ঘ আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালে যে ভূখণ্ডটি আমরা পাই তার নাম স্বাধীন বাংলাদেশ- আমাদের প্রিয় দেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে আমরা এই প্রথম নিজেদের দেশ নিজেরা শাসন করতে শুরু করি। তারপর জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা- এই দেশ শাসন করেছেন এবং করছেন।
এই তো গত ৫০০ বছরের বাংলাদেশ!
তিন.
ঐতিহাসিকভাবে যারা বাংলা শাসন করেছেন, তাদের ভেতর দুজন মানুষকে আমার ভালো লেগেছে। তার একজন হলেন শের শাহ সুরি, আরেকজন হলেন আওরঙ্গজেব। এখন থেকে মাত্র ৫০০ বছর আগে নিকোলাস কুপার্নিকাস এবং শের শাহ সুরি এই পৃথিবীতে ছিলেন। তারা খুব কাছাকাছি সময়ে মারা যান। একজন ইউরোপে, আরেকজন ভারতবর্ষে।
অতি মেধাবী এই মানুষটিকে কেউ কোনো যুদ্ধে হারাতে পারেনি। তাকে বলা হয় ‘গিফটেড’ প্রশাসক। তার সুশাসনের ফলেই পরবর্তী মোগল সম্রাট আকবরের জন্য অনেক কিছু সহজ হয়েছিল। এই শের শাহ সুরি সেই সময়ে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড তৈরি করেছিলেন, যা আমাদের এই চট্টগ্রাম থেকে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত যুক্ত করেছিল। রাস্তার পাশে প্রচুর গাছ এবং পান্থশালা করে দিয়েছিলেন। তিনি বাংলার টাকা (টংকা) থেকে রুপি মুদ্রা চালু করেন, যা ভারতবর্ষের অনেক দেশ এখনো ব্যবহার করে। রুপার মুদ্রাকে বলা হলো রুপি, সোনার মুদ্রাকে বলা হতো মোহর, আর তামার মুদ্রা হলো পয়সা। তিনি ভারতবর্ষে ডাক-সেবা চালু করেছিলেন। ঘোড়ায় করে তখন ডাক নিয়ে যাওয়া হতো।
তারপর মোগলদের ষষ্ঠ সম্রাট আওরঙ্গজেবের কথা হয়তো অনেকেই জানেন। অন্যান্য সম্রাটের মতো তিনি ভোগবিলাসিতার জীবনযাপন করেননি। তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্রের যাবতীয় সম্পদের মালিক হলো জনগণ, তিনি কেবল জামানত দেখভাল করে রাখছেন। তিনি তার জীবন চালাতেন এবং সাহায্য করতেন নিজের উপার্জন দিয়ে। উপার্জনের ভেতর ছিল তার টুপি সেলাই করা, আর কোরআন নিজের হাতে লিখে বিক্রি করা। অথচ তার সময়েই মোগল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বড় হয়।
আওরঙ্গজেব যখন ভারতবর্ষ শাসন করেছেন, তখন পুরো ভারতবর্ষে মানুষ ছিল প্রায় ১৬ কোটি। অর্থাৎ এখন বাংলাদেশে যত মানুষ আছে তার থেকে কম মানুষ ছিল পুরো ভারতবর্ষে। তার বাৎসরিক আয় ছিল ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। আর তখন ফ্রান্সের রাজা লুই ১৪-এর আয় ছিল এর দশ ভাগের এক ভাগ। ভারতবর্ষ এতটাই সম্পদশালী ছিল।
তৎকালীন পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ জিডিপি ছিল আওরঙ্গজেবের হাতে। এবং বাংলা ছিল তার আয়ের একটি বিরাট অংশ। আঠারো শ শতাব্দীতে বাংলা (বেঙ্গল সুবাহ) ছিল ভারতবর্ষের সবচেয়ে সম্পদশালী এবং শিল্পোন্নত স্থান। তখন বাংলাকে বলা হতো ‘প্যারাডাইজ অব নেশনস’। এর অধিবাসীদের আয় ছিল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর মোট জিডিপির শতকরা ১২ ভাগ ছিল বাংলার। সিল্ক, কটন, টেক্সটাইল, স্টিল, কৃষি- সবই রপ্তানি হতো এই দেশ থেকে। ঢাকা ছিল তখন তাদের রাজধানী। ঢাকার মসলিনের কথা সারা পৃথিবী জানত।
এগুলো সবই ছিল ব্রিটিশদের আসার আগে। ব্রিটিশরা আমাদের সব সম্পদ নিয়ে গিয়ে লন্ডন হয়ে উঠল সম্পদশালী। ১৭৫৭ সাল থেকে আমরা সম্পদহীন জাতিতে পরিণত হতে থাকি। আমরা আমাদের সম্পদকে ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু কেন?